রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

উদার-উদ্দাম বৈশাখ

যদি বৈশাখ প্রকৃতির দান হয়ে থাকে এবং প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রাণিকুুলের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ স্বাভাবিকভাবে সবচাইতে কল্যাণকর, সুন্দর এবং ন্যায়ও সত্য বিষয়টিকে প্রত্যাশা করবে। কাজেই আজকে বৈশাখের প্রকৃতিগত যে উদারতা, উদ্দামতা, যে পরিবর্তনের শুভ শক্তি, সেই শক্তি আমাদের ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে ও জাতীয় জীবনে কাজে লাগানো খুবই জরুরি।
অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুলস্নাহ সিকদার
  ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
উদার-উদ্দাম বৈশাখ

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সময়ের হিসাব বা সময় গণনা সভ্যতার একটি বড় নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন সভ্যতা সময় গণনার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করে এবং বিভিন্নভাবে সময়ের হিসাব করা শুরু করে। কেননা, সময়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। মানুষ তো পৃথিবীর প্রাণিকুুলের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাতি। যারা বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মানবসভ্যতাকে উত্তরোত্তর উন্নতি সাধন করেছে এবং অন্যসব প্রাণিকুুলকে তার অধীনস্ত করেছে। তবে সময়ের হিসাব প্রকৃতির মাঝে এবং অন্য প্রাণিকুুলের মাঝে প্রথম লক্ষ্য করা যায়। মানুষ লক্ষ্য করল যে, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সাজে সাজে, নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্দিষ্ট কিছু গাছে ফুল ফোটে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট গাছে ফল ধরে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকৃতির তাপমাত্রা নির্দিষ্টভাবে ওঠানামা করে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে। নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন প্রাণী বিচরণ করে। এ সব বিষয় পর্যালোচনা করে মানুষ চিন্তা করল সময়ে একটি নির্দিষ্ট আবর্তন প্রক্রিয়া আছে। যার দরুণ একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর এসব বিষয় ঘুরে ঘুরে আসে। আর এই আবর্তন প্রকৃতি এবং অন্য প্রাণিকুুল যুগ যুগ ধরে রপ্ত করে আসছে। মানুষ এই সময়ের আবর্তনকে হিসেবে রাখার জন্য পদ্ধতি আবিষ্কারের চিন্তা শুরু করল। কেননা, সময়ের এই আবর্তনকে হিসাবে না আনতে পারলে মানুষ তার জীবন ধারণের জন্য আবশ্যক কর্মকান্ড করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। মানুষ প্রথম দিকে অন্য প্রাণী শিকার করে জীবনধারণ করত। এই শিকারও সময়ের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাণী বিচরণ করে বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন সময়ে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ভ্রমণ করে। কৃষিকাজ ও সময়ের ওপর নির্ভরশীল প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বৃক্ষরাজি ফুল, ফল ও ফসল উৎপন্ন হয়। আবার প্রকৃতির তাপমাত্রা বিভিন্ন সময় ওঠানামা করে। ঝড়-বৃষ্টি সূর্য কিরণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম থাকে। বিভিন্ন সময়ে নদী এবং সমুদ্রের ভিন্ন ভিন্ন রূপ থাকে। আকাশে চাঁদ তারার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এ সব বিষয় বিবেচনা করে মানুষ সময়ের হিসেব রাখাটাকে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নেয়। দেখা যায়, বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ তাদের বর্ষপঞ্জি আবিষ্কার করেছে সময়ের হিসাব রাখতে। কোনো জাতি চন্দ্রের হিসাবে বছরের হিসাব করেছে। কোনো কোনো জাতি সূর্যের হিসাবে বর্ষ গণনা করেছে। তবে প্রকৃতির পরিবর্তন এবং কৃষি কাজের সুবিধার জন্য বাঙালি জাতি বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করে সেই গ্রেগরীয় যুগে। যা সঠিকভাবে বছরের এবং ঋতু পরিবর্তনের হিসাব রাখতে সাহায্য করে। এই বাংলা বর্ষপঞ্জিকা হিসাবে বছরের প্রথম দিন হলো বৈশাখের প্রথম দিন। একে বাঙালি বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে সেই আদি যুগ থেকে। পহেলা বৈশাখের যে উৎসব তার আঁতুড়ঘর, সৃষ্টির ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদে। নববর্ষ অর্থাৎ নতুন বছর, একেবারে নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় নতুন বঙ্গাব্দর জন্ম মোগল বাদশাহ আকবরের দরবারে। আকবরই এই সালের প্রবর্তক। বাংলাপিডিয়ায় উলেস্নখ আছে, 'কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)।' প্রধানত কৃষকদের খাজনাপাতি দেওয়ার সুবিধার্থে এই সালের প্রবর্তন করা হয়। এভাবে শুরু হয়ে এখন পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙালিদের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধনী-গরিব শ্রেণিপেশা ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে এ উৎসব সবার উৎসব।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বৈশাখ মানেই হলো একটি পরিবর্তন, একটি শক্তি, একটি প্রলয় সৃষ্টিকারী উষ্ণতার আবেশ। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার একটি শুভক্ষণ। সমস্ত জরা-জীর্ণতা প্রাণহীন শুষ্কতাকে প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবনের নতুন শক্তি সঞ্চারের আবহ তৈরির যে মাস সেটি হলো বৈশাখ। ঋতু পরিবর্তনের সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য মাস বাঙালির বাংলা বর্ষের প্রথম মাস এবং সেই প্রথম মাসকে বরণ করে নেওয়ার যে রীতি আবহমান কাল থেকে বাংলায় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে আসছে। আজকের দিনে নববর্ষ উদ্‌যাপনের এই যে চিরায়ত সাংস্কৃতিক উৎসবের রীতি সেটি শুধু বাংলাদেশে নয় বাংলা ভাষাভাষী মানুষ পৃথিবীর যেখানেই আছে এশিয়া ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে উদ্‌যাপন করতে দেখা যায়। আমি একবার লস এঞ্জেলস-এ জুন মাসে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করার অনুষ্ঠান দেখেছি বাংলা ভাষাভাষী আমেরিকানদের মাঝে। একইভাবে জাপানে নববর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, লন্ডনেও নববর্ষ উদ্‌যাপন করতে দেখেছি। সুতরাং, এই যে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের বিষয়টি এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য এবং চিরায়ত অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তা হওয়ার খুব সংগত কারণ বাংলাদেশের প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান। এই মাটি থেকে, এই জল থেকে, এই ভূমি থেকে জন্ম নেওয়া এখানকার মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বৈশাখকে ভালোবাসার যে হৃদয় সেটি নিয়ে বড় হচ্ছে এবং খুব সহজাত একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ অনুভব করে বৈশাখের পরিবর্তনের সময় বাঙালি। পৃথিবীর প্রাণী এবং জরা জগৎ প্রকৃতির লালিত সন্তানের মতো বেড়ে ওঠে অন্য প্রাণীরা যেমন- প্রকৃতির কাছে বৃষ্টি এবং ক্ষরার ওপর নির্ভরশীল বা প্রভাবিত ঠিক তেমনি মানুষও কিন্তু এই ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে নিজের জীবনকে মিশিয়ে রেখেছে, এই মেশানো কোনো অপ্রাকৃতিক নয়।

বৈশাখ প্রতি বছরই আমাদের কাছে নতুন করে ধরা দেয়। এ যেন চিরায়ত একটি অনুভূতি- যা পুরাতন হওয়ার নয়। প্রতি বছরই বাঙালি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে প্রকৃতির এই পরিবর্তনের জন্য। এই দিন এলেই প্রতিটি বাঙালি মনে একটি উৎসব উৎসব আমেজ বিরাজ করে। শুরু হয় বাঙালির বিভিন্ন আয়োজন। বৈশাখে বাঙালি নিজেদের আবার অনুভব করতে চায় বাঙালিয়ানার চর্চার মাধ্যমে। বৈশাখের শুরুতেই পান্তা ইলিশ দিয়ে হয় উৎসবের শুরু, মঙ্গল শোভাযাত্রা, সম্মিলিত বৈশাখ বরণ গান, তারপর পিঠা-পুলি, গান-বাজনা, নাচ-মঞ্চ নাটক, বৈশাখী মেলা, গ্রাম বাংলার মাঠে ঘাটে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন, বাউল গান, জারি গান, সারি গান, নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা, মেলাতে দেশি-বিদেশি পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়, কুটির শিল্পের প্রদর্শনী, হাতে তৈরি শিল্পের প্রদর্শনী, মৃত শিল্পের প্রদর্শনী, রকমারি আয়োজন, দোকানে দোকানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতা আয়োজন এরূপ বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে বৈশাখকে মানুষ বরণ করে নেয়। তবে এ বরণের সংস্কৃতি খুব স্বাভাবিক, সহজাত এবং প্রকৃতিগতভাবেই তৈরি হয়েছে।

নতুন বছর নতুন আশা-প্রত্যাশা। এ যেন নতুনকে বরণ করে পুরাতনকে ঝেরে ফেলার আনন্দ। বৈশাখের কাছে আমাদের প্রত্যশা হলো বৈশাখ সমস্ত পশ্চাৎপদতা, সমস্ত পুরাতন জীর্ণতাকে মুছে দেবে, নতুন আবহে জীবনের নতুন মাত্রা সৃষ্টির করবে, পরিবর্তনের সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসবে, নিয়ে আসবে কল্যাণের বার্তা। আজকে বাঙালি সমাজে এই যে নববর্ষের সংস্কৃতিক কর্মকান্ড, এই আবেদন নানাভাবে ব্যবসায়িক রাজনৈতিক এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থে ব্যবহার করার একটি অশুভ চর্চা দেখা যায়। আবার বৈশাখের যে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সুন্দর, সাবলিল, ঐতিহ্যগত পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতি যা বাঙালি মনকে শীতল করে আবার বাঙালির এ সংস্কৃতিকে সাড়া বিশ্বে বাঙালির বাঙালিয়ানার পরিচয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়, সেই উৎসবের সংস্কৃতি যেন অন্য কোনো বিজাতীয় উৎসবের দ্বারা, বা অন্য কোনো দেশের উগ্র, অশালীন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে কুলষিত না হয় সেদিকে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতিকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আপদমস্তক উপস্থাপন করতে হবে- যেন এ ঐতিহ্য ম্স্নান না হয়ে যায় বা হারিয়ে না যায়।

যদি বৈশাখ প্রকৃতির দান হয়ে থাকে এবং প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রাণিকুুলের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ স্বাভাবিকভাবে সবচাইতে কল্যাণকর, সুন্দর এবং ন্যায়ও সত্য বিষয়টিকে প্রত্যাশা করবে। কাজেই আজকে বৈশাখের প্রকৃতিগত যে উদারতা, উদ্দামতা, যে পরিবর্তনের শুভ শক্তি, সেই শক্তি আমাদের ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে ও জাতীয় জীবনে কাজে লাগানো খুবই জরুরি।

\হপ্রকৃতিতে যেমন পুরাতন বৃক্ষরাজি, যেমন পুরাতন জীর্ণ পাতা ফেলে দিয়ে নতুন সবুজ শ্যামল পাতায় পলস্নবিত নতুন সাজে সন্নিবেশিত হয়ে নতুন জীবনের সুধা আহরণে প্রাণ ফিরে পায় মানুষের মাঝেও প্রকৃতির এই পরিবর্তনও খুব স্বাভাবিক প্রকৃতিগতভাবেই প্রত্যাশিত। কিন্তু অপ্রাকৃতিক অমানবিক স্বার্থান্বেষী মানুষ বৈশাখে সেই উদারতাকে ভুলে যেয়ে সংকীর্ণতাকে ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা নিতে চায় সেটির পরিবর্তন করা খুবই জরুরি। সেটি সচেতনভাবে লক্ষ্য করে তার অশুভ শক্তিকে পরিহার করে, পরিত্যাগ করে, পরিবর্তন করে, পরাজিত করে শুভ ও কল্যাণকর বৈশাখের যে উদ্দাম আবেগময়ী শক্তিধর বার্তা সেটি মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো খুবই জরুরি। কারণ বাঙালির সংস্কৃতি হলো বাঙালির মানবিকতার শক্তি বাঙালির সংস্কৃতি এ দেশের জাতীয় চেতনা এবং জাতীয় ঐক্যের একটি বড় শক্তি। যখনই আমাদের দেশের সংকট আসে তখনই আমরা আমাদের সংস্কৃতির উপরে আমাদের বাঙালির সার্বজনীন বাঙালিত্বকে শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে আমরা কল্যাণের পথে হেঁটেছি। আমি বিশ্বাস করি, এবারের বৈশাখ আমাদের সমস্ত অশুভ, সংকীর্ণতা, অকল্যাণকর কর্মকান্ডের বাইরে যেয়ে উদার মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে একটি শুভ বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে। বৈশাখের নববর্ষের চর্চায় সেগুলো প্রতিফলিত হবে। আমরা অবশ্যই সুস্থ ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বৈশাখকে কল্যাণকর নববর্ষ উদযাপনের জায়গায় দেখতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, এবারের বৈশাখ হবে উদার, উদ্দাম, মানবিক ও কল্যাণকর।

অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুলস্নাহ সিকদার : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে