পহেলা বৈশাখ : অসাম্প্রদায়িক এক মিলনমেলা
শুধু গ্রাম নয়, শহর-উপশহর রাজধানী ঢাকারও বিভিন্ন অলিগলিতে বসে বৈশাখী মেলা। পান্তা-ইলিশ, বাঁশি, কাঁসর, ঢাক-ঢোলের বাজনায় আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় পূর্ণতা পায় বাঙালির এ উৎসব।
প্রকাশ | ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
তারাপদ আচার্য্য
'এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষু রে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক'
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালি জীবনের অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ, বর্ষবরণের দিন। এ দিনে প্রতিটি বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে উৎসব আমেজ। আলপনা আঁকা শাড়ি আর পাঞ্জাবি এ দিনটিকে করে তোলে আরও রঙবাহারি। লাল-সবুজ আর সাদার মিশেলে হাতে, গালে ফুলকি আঁকা এখন হালফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছরই ক্রমশ বাড়ছে বর্ষবরণের আমেজ। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচার, রমনার বটমূল থেকে পুরো ঢাকা হয়ে প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে পালন করা হয়।
\হশুধু গ্রাম নয়, শহর-উপশহর রাজধানী ঢাকারও বিভিন্ন অলিগলিতে বসে বৈশাখী মেলা। পান্তা-ইলিশ, বাঁশি, কাঁসর, ঢাক-ঢোলের বাজনায় আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় পূর্ণতা পায় বাঙালির এ উৎসব।
বাংলা সনের প্রবর্তক নিয়ে সম্রাট আকবর বেশি আলোচিত হলেও, বাংলাপঞ্জির উদ্ভাবক ধরা হয় আসলে ৭ম শতকের রাজা শশাংককে। পরবর্তীতে সম্রাট আকবর সেটিকে পরিবর্তিত করেন খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে। প্রথমে আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল 'তারিখ-এ-এলাহি' আর ওই পঞ্জিকায় মাসগুলো আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর এমন নামে। তবে ঠিক কখন যে এই নাম পরিবর্তন হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ হলো তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। ধারণা করা হয় যে, বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন- বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ এমন করেই বাংলায় নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়।
ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। আর হিজরি পঞ্জিকা ছিল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু কৃষকদের কৃষি কাজ চাঁদের হিসেবের সঙ্গে মিলতো না, তাই তাদের অসময়ে খাজনা দেওয়ার সমস্যায় পড়তে হতো। সেই কারণে খাজনা আদায়ে কৃষকদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সম্রাট আকবর বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনেন। তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেহউলস্নাহ সিরাজি সম্রাট আকবরের আদেশে সৌর সন ও হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সন গণনা করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবেই খাজনা আদায়ে এই গণনা কার্যকর শুরু হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। পূর্বে ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই বছরের নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ আর বাংলা সন করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, শুল্ক দিতে হতো কৃষকদের। তাই তখন থেকেই সম্রাট আকবর কৃষকদের জন্য মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। হালখাতার প্রচলনও সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ব্যবসায়ীরা করেছেন।
বর্তমানের বাংলা সন এসেছে গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশে এই গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালন করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকেই মঙ্গল-শোভাযাত্রা বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপনের একটি প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। উলেস্নখ্য যে, ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে আয়োজিত যে মঙ্গল-শোভাযাত্রার বের করে, সেটিকে 'মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য' হিসেবে ঘোষণা করে।
গ্রামীণ রীতি অনুসারে সকালে ওঠে মানুষ নতুন জামা গায়ে দিয়ে পরিবারের সঙ্গে নানান পদের ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত, পিঠা-পুলি, মিষ্টি খেয়ে দিনটির সূচনা করে। তাছাড়া কয়েকটি গ্রাম মিলে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও তাদের পণ্য মেলায় নিয়ে আসেন। কেউ খেলনা, কেউবা শাড়ি-চুড়ি, চুলের ফিতা, কেউ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। মেলাতে নাগরদোলাও আসে। কোনো কোনো জায়গায় জারি-সারি-ভাটিয়ালি কিংবা বাউল গানের আসর বসে। পহেলা বৈশাখে গ্রামের মানুষ এখনো হালখাতার রীতি ধরে রেখেছেন। বছরজুড়ে কেনাবেচার দোকানগুলো তাদের খরিদদারদের মিষ্টি মুখ করান।
গ্রামের পহেলা বৈশাখ পালন আর শহরে পহেলা বৈশাখ পালনে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। শহরে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় প্রতিবছর রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের অনুষ্ঠান থাকে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় রমনার বটমূল গানে গানে মুখরিত হয়ে ওঠে। সবাই মিলে একই সুরে গেয়ে ওঠে- 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো'...। পান্তা-ইলিশ আবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। বৈশাখের দিনজুড়ে চলে হৈ হুলেস্নাড় আর আনন্দ। শহরের মোড়ে মোড়ে গান-বাজনার আসর বসে। বাঙালির ঐতিহ্য যেন ধরা দেয় বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে।
তারাপদ আচার্য্য : কলামিস্ট