রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
পাঠক মত

ভুয়া ডাক্তার

খন্দকার আপন হোসাইন
  ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ভুয়া ডাক্তার

ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বিভিন্ন সংবাদ থেকে বোঝা যায় কীভাবে ভুয়া ডাক্তারের সূচনা হয়। প্রথমদিকে এরা কোনো ওষুধের দোকানে কাজ নেয়। এরপর কোনো প্রকৃত ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করে। ফার্মেসি বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছোট চেম্বারগুলোতে ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে রোগীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে এক সময় রোগীদের কাছে ভরসাযোগ্য ব্যক্তি হয়ে ওঠে। কষ্ট করে হলেও তারা কিছু ওষুধের নাম মুখস্ত করে রাখে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের ওষুধ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা লাভ করে। ওই ধারণা আর নীলক্ষেত থেকে বানানো ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে খুলে বসে প্রাইভেট ক্লিনিক। স্বীয় নামের ব্যানারে সাজিয়ে নেয় নিজস্ব চেম্বার। আবার কোনো কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইচ্ছা করেই ভুয়া ডাক্তার নিয়োগ দেয়। সেখানে তারা অতি অল্প বেতনে চাকরি করে। রোগ পরীক্ষার নামে ব্যবসা করে। দালালির মাধ্যমে রোগী সংগ্রহ করে। এরকম হাজারও ভন্ডামির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একসময় ভুয়া ডাক্তার থেকে নামকরা ডাক্তার হয়ে যায়। মেডিকেল সেন্টারগুলোয় গলায় স্টেথোস্কোপ আর গায়ে সাদা অ্যাপ্রন জড়ানো থাকলেই যে কেউ ডাক্তার হয়ে যায় না। তারপরও প্রতারক চক্রের অনেককেই ডাক্তার ভেবে ভুল করে বসে রোগীর আত্মীয়স্বজন। পরিবারের কোনো সদস্য গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন হয়। ওই পরিস্থিতিতে রোগীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। হাসপাতালে এত এত মানুষের ভিড়ে তারা নিজেদের অসহায় মনে করে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় অ্যাপ্রন পরা ভুয়া ডাক্তারের দল। ডাক্তার সেজে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা নতুন নয়। প্রতারণা করার জন্য কেন এ মহান পেশাকে বেছে নেওয়া হয়? কারণ একটাই, তা হলো প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার সংকট। দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত চিকিৎসা নিয়ে নৈরাজ্য চলে। একজন রোগী কেন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন? এই প্রশ্নের অতি সহজ উত্তর হলো রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য। রোগব্যাধির কবল থেকে রেহাই পাওয়া দূরে থাক যদি ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর জীবনাশঙ্কাই প্রকট হয়ে ওঠে তাহলে কে যে প্রকৃত দক্ষ ডাক্তার, কে হাতুড়ে ডাক্তার আর কে ভুয়া ডাক্তার তা কে খুঁজে বেড়াবে? চিকিৎসা খাত মূলত সেবা খাত এবং অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার হচ্ছে চিকিৎসা। একটি দেশ কতটা উন্নত তা ওই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান কিছু উন্নয়ন হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের এই উন্নয়ন যথেষ্ট নয়। বিশ্বজুড়ে যুগেযুগে চিকিৎসা গবেষকরা চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করেছে। মধ্যযুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে বিংশ শতাব্দীতে এসে চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন সম্ভব হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণের চিত্র দেশভেদে ভিন্নতর। উন্নত ও ধনী দেশের নাগরিক যে রকম চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকে তুলনামূলক অনুন্নত তথা দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরা সে ধরনের চিকিৎসা সেবা পায় না। এমনও দেশ আছে যে দেশে হাসপাতালই নেই। চিকিৎসা সেবা পেতে তাদের বাধ্য হয়েই অন্য দেশে পাড়ি জমাতে হয়। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমান আওয়ামী সরকারের নিপুণ ছোঁয়ায় ভালোই গতি পেয়েছে। সীমাবদ্ধতা থাকলেও গত ১৬ বছরে স্বাস্থ্য খাতে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। যেমন নির্মিত হয়েছে নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল। নির্মিত হয়েছে স্নাতকোত্তর সুপার বিশেষায়িত হাসপাতাল। নির্মিত হয়েছে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। নির্মিত হয়েছে কার্ডিওভাসকুলার হাসপাতাল। নির্মিত হয়েছে ক্যানসার হাসপাতাল। সারাদেশে এ রকম ৬২৫টিরও বেশি হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। আপামর জনসাধারণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৮ হাজার ৬০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪৩টি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে। মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে ৩১ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক চালু আছে। সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে ৩০ রকম ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। ৫ লাখ অটিস্টিক শিশুকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ১০৩টি সেবাকেন্দ্র চালু আছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিও ও ধনুষ্টঙ্কারমুক্ত দেশ ঘোষণা করেছে। প্রতিটি জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। দেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে আশাব্যঞ্জক সফলতা হাতছানি দিচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জিডিপির ০৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক সব ভালো কাজ মলিন হয়ে যাবে যদি চিকিৎসা ব্যবস্থার আড়ালে লুকিয়ে থাকা থলের বেড়ালের রহস্য উদ্ঘাটন না হয়, যদি চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি বন্ধ না হয়, যদি ডাক্তার পরিচয় দেওয়া ভন্ড প্রতারকদের শাস্তির আওতায় আনা না হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০ এর ধারা ২৮(৩) ও ২৯(২) অনুযায়ী একজন ভুয়া ডাক্তারের সাজা হিসেবে ৩ বছরের কারাদন্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান রয়েছে। এ শাস্তি পর্যাপ্ত নয়। ভুয়া ডাক্তারের শাস্তি মৃতু্যদন্ড অথবা যাবজ্জীবন হওয়া উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। এ ব্যাপারে আদালতে রিটও করা আছে। চিকিৎসা পেশা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমডিসি চিকিৎসকদের চিকিৎসা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি বা নিবন্ধন দিয়ে থাকে। বিএমডিসির অফিসিয়াল তথ্যানুসারে দেশে নিবন্ধনহীন ক্লিনিক যেমন আছে তেমনি অসংখ্য ভুয়া ডাক্তারও রয়েছে। কে প্রকৃত ডাক্তার আর কে ভুয়া সেটা কে খোঁজে বের করবে? প্রশ্ন থেকেই যায়। চিকিৎসা সেবাদান অত্যন্ত মানবিক পেশা। চিকিৎসা ব্যবস্থার বিপর্যয় রোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল অর্থ উপার্জনের আশায় ডিগ্রিহীন কোনো ভুয়া ডাক্তার যেন এ পেশায় ঢুকতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে। সেবাদান পেশায় নিয়োজিতদের দায়িত্ববোধের ঘাটতি দূরীকরণে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে ব্যাঙের ছাতার মতো 'বাণিজ্যকেন্দ্র' নির্মাণ বন্ধে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে। প্রতিটি চিকিৎসাকেন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট অনুশাসন ও শৃঙ্খলাবিধি প্রদান করতে হবে। ভুয়া ডাক্তার শনাক্তকরণে বিশেষ টিম গঠন করতে হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা পরিলক্ষিত হলে সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। তবে আর কেউই বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে খলনায়কের ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

খন্দকার আপন হোসাইন

ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল

ঘাটাইল, টাঙ্গাইল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে