নাজাতের দশকে লাইলাতুল কদর

মহান আলস্নাহতায়ালার কাছে এ দোয়াই করি, তিনি যেন এই পবিত্র রমজানে আমাদের সবাইকে নাজাত দান করেন এবং তার রহমতের ছায়ায় আবৃত করে রাখেন, আমিন।

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

মাহমুদ আহমদ
দেখতে দেখতে আমাদের মাঝ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে এখন নাজাতের দশক চলছে। অনেকেই নাজাতের দশ দিন আলস্নাহতায়ালার নৈকট্য অর্জনে একনিষ্ঠভাবে ইবাদতে রত থাকার জন্য মসজিদে ইতিকাফ করছেন। রমজানকে বিদায় দিতে গিয়ে আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর এমনটি হয়ে থাকত যে, আধ্যাত্মিক বসন্ত নিজের চমক দেখিয়ে যখন বিদায় নেওয়ার ক্ষণে পৌঁছে যেত তখন তিনি (সা.) কোমর বেঁধে নিতেন আর রমজানের কল্যাণরাজিতে নিজ ডালি ভরে নিতে কোনো ত্রম্নটি করতেন না। হজরত রসুল করিম (সা.)-এর শেষ দশকের ইবাদত সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি রমজানের শেষ দশকে প্রবেশ করলে তিনি (সা.) কীভাবে কোমর বেঁধে নিতেন অর্থাৎ খুবই তৎপর হতেন এবং নিজ রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জীবিত করতেন। সঙ্গে সঙ্গে তার (সা.) পরিবার পরিজনকেও জাগাতেন (বোখারি, কিতাবুস সওম)। শেষ দশকে হুজুর (সা.) ইতিকাফে বসতেন এবং লাইলাতুল কদরের অন্বেষণে রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জাগিয়ে রাখতেন। ইতিকাফের আভিধানিক অর্থ হলো কোনো স্থানে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া বা অবস্থান করা। ইসলামি পরিভাষায় 'ইবাদতের সংকল্প নিয়ে রোযা রেখে মসজিদে অবস্থান করার নাম ইতিকাফ' (হিদায়া, বাবুল ইতিকাফ)। রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফে বসা সুন্নতসম্মত। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদীস থেকে জানা যায়, হুজুর (সা.)-এর মৃতু্যর পর তার (সা.) পবিত্র স্ত্রীগণও এ সুন্নতের অনুসরণ করতেন (সহি মুসলিম, কিতাবুল ইতিকাফ)। হুজুর (সা.) রমজান মাসে ১০ দিনই ইতিকাফে বসতেন। উলেস্নখ্য, হজরত নবী করিম (সা.) জীবনের শেষ রমজানে ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। ইতিকাফে বসে মুতাকিফরা একাগ্রচিত্তে ব্যক্তিগত দোয়া ছাড়াও সবার জন্য সময়োপযোগী দোয়া করেন। ইতিকাফের জন্য উপযুক্ত স্থান হলো জামে মসজিদ। এ প্রসঙ্গে কোরআন করিমে উলেস্নখ রয়েছে, 'ওয়া আনতুম আকিফুনা ফিল মাসাজিদ' অর্থাৎ তোমরা মসজিদে ইতেকাফ কর (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৭)। হাদিসেও নির্দেশ এসেছে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, 'লা ইতিকাফা ইলস্না ফিল মাসজিদুল জামে' অর্থাৎ জামে মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ নেই। (আবুদাউদ, কিতাবুল ইতিকাফ, পৃ. ৩৩৫)। ইমামগণ এ বিষয়ে ঐক্যমত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, বিভিন্ন অসুবিধার কারণে ইতিকাফ যে কোনো মসজিদে বা অপারগতার কারণে মসজিদের বাইরেও ইতিকাফ হতে পারে। মহিলারা ঘরে নামাজের জন্য একটি বিশেষ স্থান নির্ধারণ করে সেখানে ইতিকাফে বসা তাদের জন্য উত্তম (হিদায়া, বাবুল ইতিকাফ, পৃ. ১৯০)। ইতিকাফকারী দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে আলস্নাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে যেন তিনি তার অভীষ্ট মনোবাসনা পূর্ণ করে তবে ইতিকাফ থেকে উঠতে পারেন। এটা কঠিন সাধনার বিষয়। তাই মুতাকিফকে এমন কোনো কাজকর্ম বা আচার-আচরণ করা উচিত নয় যাতে তার এ সাধনা ব্যাহত হয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয় অথবা ত্রম্নটিপূর্ণ হয়ে যায় বা তার মনোবাসনা অপূর্ণ থেকে যায়। একজন তাপসের সাধনার ন্যায় একাগ্রতা ঐকান্তিকতা শৃঙ্খলা ও পবিত্রতার লাগাম যেন হাত ছাড়া হতে না দেন। রমজানের এই শেষ দশকের একটি রাতে এসে থাকে লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনি লাভ বোধ করি মুমিনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সারা জীবন কঠোর সাধনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে শয়তানী প্রবৃত্তিরূপে দৈত্যকে নিধন করার পর মুমিনের কাছে আসে সেই মুহূর্তটি, সেই পাওয়ার মুহূর্তটি যা আল কোরআনের সুরা কাদরে 'লাইলাতুল কদর' নামে আখ্যায়িত হয়েছে। হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এ মুহূর্তটি। লাইলাতুল কদর বলতে আমরা সাধারণত একটি রাতকে মনে করে থাকি। ভৌগোলিক কারণে সারা দুনিয়ায় যেহেতু একই সময়ে রাত থাকে না সেজন্যে লাইলাতুল কদরকে আমাদের গণনার একটি রাত নির্ধারণ করা সঠিক বলে মনে হয় না। লাইলাতুল কদর এমন একটি সময় মুমিনের ব্যক্তিগত জীবন বা জাতীয় তথা মিলস্নাতি জীবনে রাতের ন্যায় কাজ করে থাকে। মুমিন সাধনার শেষ লগ্নে তার প্রভুর দিদার বা দর্শন ও সান্নিধ্য লাভ করে বাক্যালাপে ভূষিত হয়। এ মুহূর্তটিই আসলে তার জীবনে লাইলাতুল কদর। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ মুহূর্তটি অবশ্যই মুমিনের জীবনে আসে রমজানের কঠোর সাধনার শেষ দশকে। রোজার সাধনার মাধ্যমে মুমিন পানাহার ত্যাগ করে, নিদ্রাকে কম করে দিয়ে এবং নিজের প্রজননকে সাময়িকভাবে হলেও স্বীকার করে আলস্নাহর রঙে রঙিন হয়। তাই সে আলস্নাহর সঙ্গে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বাক্যালাপ করার সৌভাগ্য লাভ করে। হাদিস পাঠে জানা যায়, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রসুল করিম (সা.) কদরের রাত্রি সম্বন্ধে বলেছেন, 'রমজান মাসের শেষের দশ রাত্রিসমূহে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান কর' (বোখারি)। তিনি (সা.) আরও বলেছেন, 'তোমাদের কাছে রমজান এসেছে। রমজান মোবারক মাস। এর রোজা আলস্নাহ তোমাদের প্রতি ফরজ করেছেন। এ মাসে বেহেশতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করা হয়েছে আর দোযখের দ্বারসমূহ বন্ধ করা হয়েছে এবং দুষ্কৃতকারী শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়েছে। এ মাসের একটি রাত্রি যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত, সে সব প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত' (বোখারি)। হাদিস থেকে আরও জানা যায়, হজরত আয়েশা (রা.) নবী করিম (সা.)-এর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি লাইলাতুল কদর লাভ করলে কি করব? হজরত নবী করিম (সা.) তাকে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করতে বললেন, 'আলস্নাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্নি অর্থাৎ হে আলস্নাহ! নিশ্চয় তুমি মার্জনাকারী। মার্জনাকে তুমি ভালোবাস। অতএব, তুমি আমাকে মার্জনা কর' (তিরমিযি)। এ রাতটি মুসলমান নর-নারী সবার নিকট অতীব মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত রাত বলে সর্বাধিক সমাদৃত। ৩৬৫ দিবস রজনি নিমগ্ন চিত্তে বিনীত ইবাদত ও পরিশুদ্ধ জীবনযাপন করার বিনিময়ে আরবি রমজান মাসের শেষ দশক অর্থাৎ নাজাত দশকের বেজোড় রাতগুলোর একটি রাতে সম্মানিত এই রজনির আগমন হয়ে থাকে। এ রাতের মর্যাদা সমবেত অন্য সব রাতের একীভূত ইবাদতের মূল্যের চেয়েও বেশি। এ রাতের মান-মর্যাদা, সম্মান-সম্ভ্রম ও মাহাত্ম্য মহিমা অতুলনীয়। আত্মার মঙ্গল সাধনের জন্য দরকার এমন সর্ব প্রকার প্রাচুর্যে ভরপুর এ রাত। মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মিটানোর সব কিছুই এ রাতে প্রচুর পরিমাণে নিহিত। সুতরাং এ রাতের কল্যাণ লাভের প্রত্যাশায় এই শেষ দশকের প্রত্যেকটি সময় কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরের অন্বেষণ করতে হবে। আর রমজান মাসের শেষ দিনগুলোতে আমাদের সবার বেশি বেশি উপরোক্ত দোয়াটিও করা উচিত। মহান আলস্নাহতায়ালার কাছে এ দোয়াই করি, তিনি যেন এই পবিত্র রমজানে আমাদের সবাইকে নাজাত দান করেন এবং তার রহমতের ছায়ায় আবৃত করে রাখেন, আমিন। মাহমুদ আহমদ :প্রাবন্ধিক ও গবেষক