জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে

বাংলাদেশ এখন সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত। আর তাই এখন বেকারত্বকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টি অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি উন্নয়নকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরি করে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিদেশি পুঁজির নিগূঢ় শিকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

দয়াল কুমার বড়ুয়া
যে কোনো দেশে মানুষই সম্পদ। মানুষের শ্রমে-ঘামে-মেধায়-পরিকল্পনায় একটি দেশ বা জাতির অগ্রগতি নিশ্চিত হয়। গত রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস)-২০২৩'-এর ফল প্রকাশ করেছে। এসভিআরএস-২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার হয়েছে। ২০২২ সালে ছিল ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারী ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৯০ হাজার ও পুরুষ ৮ কোটি ৪২ লাখ। জনসংখ্যা বাড়লেও গড় আয়ু সামান্য কমেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৭২.৪ বছর- যা ২০২৩ সালে হয়েছে ৭২.৩ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর ২০২৩ সালের 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬৩.৩ শতাংশ- যা পরের বছরে কমে গেছে। ২০২৩ সালে ওই হার হয়েছে ৬২.১ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শহর-গ্রাম উভয় এলাকায়ই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী কমেছে। তবে শহরের চেয়ে গ্রামে কমেছে বেশি। কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। ২০২৩ সালে জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ছিল ১.৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ১.৪০ শতাংশ। বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস থেকে কিছু ইতিবাচক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন- ২০২৩ সালে দেশে তালাকের প্রবণতা কমেছে। দাম্পত্য বিচ্ছেদের হারও কমেছে। বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী সাত বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সি জনসংখ্যার সাক্ষরতার হার ২০২৩ সালে ৭৭.৯ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৭৬.৮ শতাংশ। নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সাক্ষরতা প্রায় একই হারে বেড়েছে। তবে একটি খারাপ খবর এসেছে বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যে। বলা হয়েছে, দেশের ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ গত বছর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ২০২৩ সালে তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হিসেবে ছিল না। মোট জনসংখ্যার হিসেবে শিক্ষার বাইরে থাকা শিশু ও তরুণের এই সংখ্যা ২ কোটি ৬২ লাখের বেশি। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রতি হাজারে ৮.৭৮ জন দেশ ছেড়েছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজারে ৬.৬১ জন। এক বছর আগে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৫টি দেশের জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন তরুণ জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ কর্মক্ষম শক্তিকে কাজে লাগানোই দেশের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও ইউএনডিপির মতে, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জনশক্তিকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সেটি করতে পারলে জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হবে। বাংলাদেশ জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমবেশি সফলতা অর্জনকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখনো একটি বড় সমস্যা। কেননা, এখানকার জনঘনত্বের হার সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে ঘাটতি আমাদের আর্থসামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অশিক্ষার শিকার হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। একটি দেশে জনসংখ্যা তখনই সম্পদে পরিণত হয়, যখন প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা যায়। কিন্তু এ চাহিদাগুলো পূরণে এখনো বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিকল্পনার অভাবে পুরো জনসংখ্যাকে কার্যকর জনসম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে বৈষম্য। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে এ ঘাটতিগুলো পূরণ করা অপরিহার্য। দেশের আয়তন সীমিত, বিপরীতে জনসংখ্যা অনেক বেশি। জনঘনত্বের বিচারে পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশ। জনসংখ্যাকে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে সুশিক্ষা-সুস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার। ২০৪১ সালের মধ্যে 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। দেশকে সমৃদ্ধ, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হলে, জনসংখ্যার বিরাট বোঝাকে অভিশাপ মনে না করে আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাই আমাদের অর্থনীতির চেহারাটা আরও বদলে দিতে পারে। দেশে তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরি নিয়ে যেতে পারে তারা। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে উপযুক্ত এবং ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ পেতে পারে তারা অনায়াসেই। এভাবে আমাদের প্রবাসী রেমিট্যান্স ধারায় বিপুল জোয়ার সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ এখন সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত। আর তাই এখন বেকারত্বকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টি অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি উন্নয়নকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরি করে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিদেশি পুঁজির নিগূঢ় শিকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দয়াল কুমার বড়ুয়া : রাজনীতিক ও কলামিস্ট, ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি