করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ যখন থাবা বিস্তার করেছিল দুনিয়াজুড়ে তখন অনেক দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক সূচকও দেখা গেছে অনেক দেশে। সে অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দাম ছিল ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। করোনাকালে ভোজ্য তেলসহ অনেক নিত্যপণ্যের দাম কমেছে। করোনার অভিশাপ থেকে বিশ্ববাসী মুক্তি পেলেও এর প্রভাবে অর্থনীতিতে যে মন্দা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে মুক্তি পায়নি। করোনার অভিশাপ না কাটতেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর সংকট আরও বাড়িয়েছে।
সে সংকটে বাংলাদেশের মানুষ কতটা অসহায় তার প্রতিফলন ঘটেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্নাবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিটের এক যৌথ সমীক্ষা জরিপে ওঠে এসেছে, ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর সময়কালে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য গ্রামীণ এবং শহুরে পরিবারগুলোর জন্য ছিল একটি প্রধান ধাক্কা। মূল্যস্ফীতির চাপ ছাড়াও এ সময় কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য, ফসল, গবাদিপশুর রোগ, পরিবারের সদস্যের উপার্জন হ্রাস, বন্যা, ফসলের কম দাম ইত্যাদির প্রভাব ছিল। এর প্রভাব কাটাতে পরিবারগুলো খাদ্যাভ্যাসের ধরনগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করেছে। তা ছাড়া সঞ্চয় কমে যাওয়া, ঋণ গ্রহণ ছাড়াও বন্ধু বা আত্মীয়দের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হয়েছে।
এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাবে ৭০ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে। ৩৫ শতাংশ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হ্রাস করেছে। ২৮ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে এবং ১৭ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় হ্রাস করেছে।
যৌথ সমীক্ষায় স্পষ্ট হয়েছে বিশ্বজুড়ে যে মন্দা চলেছে তার প্রভাব প্রকটভাবে পড়েছে বাংলাদেশেও। এ প্রভাবের ফলে সুখ ও স্বস্তিতে নেই স্বল্প আয়ের মানুষ। মন্দা মোকাবিলায় নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকারকে যত্নবান হতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত ১১টি নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন সেবার মূল্য এক বছরের ব্যবধানে সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য ওঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ডিম, মাংস, সবজি, ভোজ্যতেল, বিবিধ খাদ্যপণ্য, কোমল পানীয়, কাপড়, জুতা, জ্বালানি ও বাসাভাড়া। এ ছাড়া গৃহসামগ্রী, গণপরিবহণ, বিনোদন ও শিক্ষা এবং বিবিধ পণ্য ও সেবাও রয়েছে এ তালিকায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব পণ্য ও সেবার দাম বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা হলো, বিদ্যমান দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মানুষের আয় মোটেই বাড়েনি। এ প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করে জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের সিংহভাগ মানুষ। তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা অসহায়বোধ করছেন।
অনেকের অভিযোগ দেশের ব্যবসায়ীরা পকেট স্ফীত করার বাইরে অন্য কিছু ভাবেন না, জনস্বার্থকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। ব্যবসায়ীদের এহেন আচরণ ও কর্মকান্ড অযৌক্তিক, অমানবিকও বটে। এ অবস্থায় লোকঠকানো মানসিকতা পরিহার করে তেল, চিনিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ী সমাজকে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে।
করোনায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা। দেশে এত বড় বাজার, যা শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে 'ন্যায্যতার' মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে না পারলে দ্রব্যমূল্য কেন, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
সব কিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। চাহিদার সঙ্গে দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো দৃশ্যত কিছু বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ব্যবস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। এটা স্পষ্ট যে, করোনা-দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। এখন বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহণ নির্বিঘ্ন রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।
পরিশেষে বলছি, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনায়ও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত- এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখারও নিশ্চিত করতে হবে।
আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ