দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার কতটা সোচ্চার?
এটা সত্য, এই সমাজে সৎভাবে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা যেন ২৪ ঘণ্টা আগুনে হাত রাখার মতো। অসৎ বা অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং সমাজকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। চারদিকে তারই ধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি।
প্রকাশ | ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
সালাম সালেহ উদদীন
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্বিত ও আশাবাদী। এই দেশ একদিন উন্নত দেশের কাতারে যাবে। এমন স্বপ্ন দেশদরদি জনগণ দেখে, দেখে সরকারও। এ বিষয়ে সরকারের নানা কর্মকান্ড ও প্রচার চোখে পড়ে। দৃশ্যত সরকার তৎপর ও মনোযোগী। তবে প্রত্যাশা করা, স্বপ্ন দেখা আর তা বাস্তবে রূপ দেয়া এক কথা নয়। কঠিন সাধনার মাধ্যমে সত্যের মুখোমুখি হওয়া এবং তাকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। পরিকল্পনা পরিশ্রম, গঠনমূলক চিন্তা ছাড়া যেমন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়, একইভাবে সম্ভব নয় রাষ্ট্রের উন্নয়নও। রাষ্ট্র তা যত ক্ষুদ্রই হোক তার চরিত্র হতে হয় গণমুখী তথা জনকল্যাণমূলক। জনস্বার্থ উপেক্ষিত রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশকে নিয়ে বিগত পাঁচদশকের বেশি সময় ধরে অনেক স্বপ্ন দেখলেও রাষ্ট্রের কাঠামোগত চরিত্র দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। যদিও বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে এশিয়ার বাঘ উন্নয়নের রোল মডেল। এখন বলা হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ।
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশ এতটাই আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ হেনরি কিসিঞ্জার এই দেশকে একটি 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেই হেনরি কিসিঞ্জার আবার শত বছর বেঁচেছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে তিনি দ্বিতীয় কোনো মন্তব্য করেন নি। ১৯৭১ সালের সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশের ঈপ্সিত প্রবৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হারও অনেক বেড়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর হার কমেছে। যদিও মুদ্রাস্ফীতির চিত্র সন্তোষজনক নয়। অর্থনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত। তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক ভালো। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, যদিও সাম্প্রতিক জরিপে মানুষের গড় আয়ু কিছুটা কমেছে। সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আশাব্যঞ্জক অবস্থানে ছিল, তবে এবার পিছিয়েছে ১১ ধাপ। পিছিয়ে রয়েছে গণতন্ত্র চর্চার দিক থেকেও। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে 'ভিশন-২০৪১' কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার- যা সফল হওয়ার পথে। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর স্বীকৃতি মিলেছে। এখন স্বপ্ন হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার। আমাদের এসব অর্জন ধরে রাখতে হবে।
তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশ এক সময় দুর্নীতির জন্য পর পর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দুর্নীতির সেই কলঙ্ক-তিলক মোচন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি- এটা যেমন সত্য, একইভাবে সত্য যে, আমরা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে পারিনি। যার কারণে আমাদের আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তার রয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি। ইতোমধ্যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। তিনি আরো বলেছিলেন, ফাঁকফোকর কোথায় এবং কারা উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। অসৎ দুর্নীতি-অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িত থাকলে দলের লোকদেরও ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করেছেন তিনি। তিনি এ কথাও বলেছিলেন, 'আমি একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই, এই অসৎ পথ ধরে কেউ উপার্জন করলে, অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা বা অসৎ কাজে যদি ধরা পড়ে, তবে সে যেই হোক না কেন, আমার দলের হলেও ছাড় হবে না, এর বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।' দুর্নীতি পাশাপাশি মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথাও বলেছেন তিনি। তার এই কথার পরে অনেক রাঘববোয়াল ধরা পড়েছে। আবার নতুন করে রাঘববোয়াল জন্ম নিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, এ সমাজে অপরাধী একজন নয়, অনেক। যদি সঠিকভাবে অভিযান চালানো যায় তবে ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কথায় বলে ক্ষমতা পেলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। কীভাবে ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নয়, অপব্যবহার করা যায় সে চেষ্টায় সারাক্ষণ মত্ত থাকে। ছোট ক্ষমতা ছোট অপরাধের জন্ম দেয়, বড় ক্ষমতা জন্ম দেয় বড় অপরাধের। ক্ষমতা পাওয়ার পর জীবনকে কর্মকান্ডকে স্বচ্ছ রেখেছেন এমন নেতা, সরকারি কর্মকর্তা বিরল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই অসৎ পথে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে শত শত কোটি টাকা বানানো। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে একজন সরকারি কর্মকর্তার যে অবৈধ সম্পদের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তা কেবল বিস্ময় জাগায়। কী পরিমাণ ক্ষমতার অপব্যবহার ওই ব্যক্তি করেছেন, তা সাধারণ বুদ্ধিতে ধরে না। না হলে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হলেন কী করে?
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে একদিন যিনি রাস্তার লোক হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, ক্ষমতাসীন দলে কৌশলে ঢুকে যাওয়ার কারণে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, এই সুযোগ তাকে কে করে দিয়েছে। দলের মধ্যে যদি বিশেষ স্বচ্ছ শক্তিশালী মনিটরিং সেল থাকতো তা হলে অপরাধের বা দুর্নীতির একটি চিত্র জনগণ পেত। অপরাধ ধরা পড়লে তাৎক্ষণিক শাস্তি ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সৎ আদর্শিক দেশপ্রেমিক না হলে, তিনি তো সুযোগ পেলে লুটপাট করবেনই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতক বাস্তবতা।
এটা সত্য, এই সমাজে সৎভাবে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা যেন ২৪ ঘণ্টা আগুনে হাত রাখার মতো। অসৎ বা অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং সমাজকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। চারদিকে তারই ধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি।
মনে রাখতে হবে- সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা সহজ কাজ নয়। আর এটা প্রধানমন্ত্রীর একার কাজও নয়। এটা হচ্ছে সম্মিলিত কাজ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই যুদ্ধে জয়লাভ করতেই হবে। না হলে আমাদের রক্ষা নেই।
\হতবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় বাধা। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন- যা রীতিমতো ভয়ংকর। এখন মনে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করেও কোনো লাভ হয়নি। তাদের লোভ ও মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকারি কোনো কাজের জন্য ১০ জায়গায় ধরনা দিতে হয়। ঘুষ দিতে হয় প্রতিটি টেবিলে। তারপরও সময়ের কাজ সময়ে হয় না। দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে কাজের পরিবর্তে কীভাবে চুরি দুর্নীতি লুটপাটের মাধ্যমে ধনী হওয়া যায় সর্বক্ষণ সেই চিন্তায় ব্যস্ত থাকেন। এভাবে যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্র ধরে ধরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জায়গায় নিয়ে আসা যায় তবে চরম হতাশা ও নৈরাজ্যজনক চিত্রই চোখে পড়বে। ফলে আশাবাদী হওয়ার আর সুযোগ থাকবে না।
বাংলাদেশের সাফল্যের তালিকা আরো অনেক বেশি দীর্ঘ হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। যদিও সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও রয়েছে- এটা স্বীকার করতেই হবে। দুর্নীতি নির্মূল করতে না পারা এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা। তবে হতাশ হলে চলবে না, চলবে না মনোবল হারালেও। আমাদের দৃঢ়চেতা মানসিকতা নিয়ে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জয় আমাদের হবেই।
সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক