সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নিরাপদ হোক প্রিয়জনের কাছে ফেরা

এই যাত্রা যদি হয় বেদনাদায়ক- তাহলে পুরো ঈদের খুশিটাই যেন বিলীন। সেজন্য ঈদের ছুটি উপলক্ষে সড়কগুলো নিরাপদ করতে এখন থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
তরিকুল ইসলাম
  ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
নিরাপদ হোক প্রিয়জনের কাছে ফেরা

রমজানে টানা এক মাস রোজা শেষে খুশি নিয়ে হাজির হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। আর এ ঈদের সেই খুশিকে পরিবারের সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পরিবার, আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের কাছে সবাই ছুটে আসে নিজ নীড়ে। ঈদ যাত্রায় পথে পথে লাখো মানুষের যাতায়াত ঘটে। রোডক্র্যাশের (সড়ক দুর্ঘটনা) কারণে এই যাত্রা কোনো কোনো পরিবারের ঈদ আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। এত মানুষের একসঙ্গে ঘরে ফেরার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ সড়ক ও পরিবহণ ব্যবস্থা। ঈদ উদযাপন মানেই ঘরে ফেরা, প্রিয়জনের কাছে ফেরা। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সব স্তরের মানুষের মাঝে, ঈদে বাড়ি ফেরার যাত্রা হোক নিরাপদে। প্রতি ঈদে নাড়ির টানে মানুষ নিজ বাড়িতে পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যে যায়। কারণ, বছর শেষে আনন্দের দিনটি সবাই একসঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষেও পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে মানুষ ছুটছে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু আমাদের দেশের সড়কগুলো যেন হয়ে উঠছে এক একটি মৃতু্য ফাঁদ। প্রতিনিয়ত রোডক্র্যাশের খবর আমরা পাচ্ছি। যতদিন যাচ্ছে আহত ও মৃতু্যর সংখ্যা ততই বাড়ছে। গেস্নাবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি-২০২৩ এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে রোডক্র্যাশে প্রতিদিন গড়ে মৃতু্য হচ্ছে প্রায় ৮৭ জনের। বাংলাদেশে রোডক্র্যাশে মৃতু্যর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সড়কে মানুষের জীবন বাঁচাতে চাই কার্যকর উদ্যোগ। এই রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে দরকার 'সড়ক নিরাপত্তা আইন'। সামনে ঈদুল ফিতর। বিগত বছরগুলোর মতো এ সময়ে রোডক্র্যাশ বাড়তে পারে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পত্রপত্রিকা ও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় ও যাচাই-বাছাই করে এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ঈদ যাত্রাকালীন-১৭ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ দিনে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাব অনুযায়ী ১৪২টি রোডক্র্যাশে ১৩৬ জন নিহত ২৫৮ জন আহত হয়।

এই যাত্রা যদি হয় বেদনাদায়ক- তাহলে পুরো ঈদের খুশিটাই যেন বিলীন। সেজন্য ঈদের ছুটি উপলক্ষে সড়কগুলো নিরাপদ করতে এখন থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

রোডক্র্যাশে বছরে এত সংখ্যকলোকের মৃতু্য খুবই উদ্বেগজনক। এতে জিডিপির তিন শতাংশের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। বিআরটিএ এর তথ্যানুযায়ী গত ফেব্রম্নয়ারি মাসে দেশে ৫৯৬টি রোডক্র্যাশে ৫২৩ জননিহত আর ৭২২ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলেছে, গত ফেব্রম্নয়ারি মাসে ৫০৩টি রোডক্র্যাশে ৫৫৫ জন নিহত, ১০৩১ জন আহত হয়েছে। বিশ্বে ৫ থেকে ২৯ বছরবয়সি মানুষের মৃতু্যর প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। এই অকাল মৃতু্য প্রতিরোধে দরকার সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন। সড়ক পরিবহণ বিধিমালা-২০২২ এ সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ওই বিধিমালায় গাড়ির গতিসীমা, সিটবেল্ট, মানসম্মত হেলমেট, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশু আসন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয়নি। বেপরোয়া গতি, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা করা, সাইকেল-রিকশা-মোটরগাড়ি একই সঙ্গে চলাচল করার ফলে রোডক্র্যাশ নেমে আসছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও চালকরা তার কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রতি বছর ঈদ পূর্ব যাতায়াতকালে রোডক্র্যাশে মানুষ মারা যাচ্ছে। ঈদুল ফিতর-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে সড়কপথে যাত্রী সাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন ওনিরাপদ করার লক্ষ্যে এবং আনন্দযাত্রায় রোডক্র্যাশে শত শত মানুষের মৃতু্যঠেকাতে যেসব পদক্ষেপ দ্রম্নত নেয়া দরকার তা হলো: অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে স্পিডগান ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, প্যাডেলচালিত রিকশা, অটোরিকশা, নছিমন-করিমন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রোডক্র্যাশ এড়িয়ে ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হলে মোটরসাইকেল চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সড়কে এখন সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে মোটর সাইকেলের কারণে। তাছাড়া ঈদ যাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলে পুলিশ এবং সংশ্লিষ্টদের নজরদারি জোরদার করতে হবে। তবে শুধুমাত্র চালকের বেপরোয়া গতিই রোডক্র্যাশের একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ ড্রাইভার, ভুয়া লাইসেন্স, অতিরিক্ত পণ্যসামগ্রী বা যাত্রী পরিবহণ, চালকের ট্রাফিক আইনসম্পর্কে অসচেতনতার অভাব, চলন্তবাস, ট্রাকে, মুঠোফোন ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে রোডক্র্যাশ ঘটে। আবার অনেক সময় দেখা যায় খারাপ রাস্তায়ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও ওভারটেক করার হীনমানসিকতাও এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। মূলত নাড়ির টানে ঘরে ফেরা মানুষের আসল যুদ্ধ শুরু হয় পবিত্র ঈদ এলেই। প্রতি বছরই ঈদে নগরবাসী মানুষের বাড়ি ফেরার সময় পড়তে হয় নানা রকমভোগান্তিতে। অনেকের তো বাড়িই ফেরা হয় না। রোডক্র্যাশ, অতিরিক্ত যানজটসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতেই থাকে। পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের জন্য নিয়মিত রাস্তাঘাট মেরামতসহ গতিবিধি মেনে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করতে পারলে অনেকাংশেই রোডক্র্যাশ রোধ করা যাবে। গতিবিধি না মেনে গাড়ি চালালে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। আপনজন হারানোর বেদনা শুধু স্বজনরাই অনুভব করছেন বারবার। কে, কখন, কোথায়, কীভাবে রোডক্র্যাশের সম্মুখীন হবেন তা কেউ জানে না। বাস্তবিক অর্থেই এটা এখন মহামারির রূপ নিয়েছে। এর নিযন্ত্রণ করতে হবে, থামাতে হবে শব যাত্রার মিছিল। তবেই হয়ত উৎসবে নাড়ির টানে যাত্রা আর ফিরতিকালে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়বে না কেউ, বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার সময় লাশ হয়ে ফিরবে না! রোডক্র্যাশে এই মৃতু্যর মিছিল সামাল দিতে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা জনগণ ভীষণভাবে অনুভব করছে। রোডক্র্যাশ নিয়ন্ত্রণে আসুক, প্রতিটি উৎসব হোক নিরাপদ, উৎকণ্ঠাহীন, বর্ণিল ও আনন্দময়।

তরিকুল ইসলাম : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে