আত্মহত্যা করার প্রবণতা সমাজে ক্রমেই বাড়ছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও আত্মহত্যার প্রবণতা চোখে পড়ে। প্রতি বছর সারাবিশ্বে ৮ লাখ মানুষ এই পথ বেছে নেয়। যদিও প্রচলিত আইনে আত্মহত্যা অপরাধ হিসেবে গণ্য। আত্মহত্যা জীবনের একটি অমীমাংসিত সমাধান। স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেয় ভীরু কাপুরুষ যারা- তারা। এই কথাও সমাজে প্রচলিত রয়েছে। অথবা এটাও বলা যেতে পারে যে, যারা জীবনকে ভালোবাসে না কেবল তারাই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা মহাপাপ। ধর্ম এটাকে সমর্থন করে না; বরং এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যা। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মৃতু্যর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ এটি। প্রতি বছরই তা বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে আদ্রিতা বিনতে মোশারফ (১৯) নামে এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস নিয়েছেন। তিনি মার্কেটিং বিভাগের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ৩০ মার্চ শনিবার দিনগত রাত ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আদ্রিতার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মোশারফ হোসেন। এ ধরনের মর্মান্তিক মৃতু্যর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
সারাদেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এই সমীক্ষার তথ্য বলছে, আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪০ জন বা ৬৪ শতাংশই স্কুল পর্যায়ের। এছাড়া কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সমমান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী এই এক বছর আত্মাহুতি দিয়েছেন বলে উঠে এসেছে আঁচলের সমীক্ষায়। দেশের আট বিভাগে আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে- যা মোট আত্মহত্যার প্রায় ২৩.৭৭ শতাংশ। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩.৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৮৫ জনই মেয়ে; বাকি ১৬১ জন, অর্থাৎ ৩৬.১ শতাংশ ছেলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মৃতু্যর হার প্রতি লাখে ১৬ জন। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন- যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকসেবন বেড়ে যাওয়া, কর্মসংস্থানের অভাব, পারিবারিক কলহ, নির্যাতন, ভালোবাসায় ব্যর্থতা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, বেকারত্ব, যৌন নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণসহ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। ইদানীং পুরুষের চেয়ে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আত্মহত্যার ৯৭০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন এবং ইভটিজিংয়ের ঘটনা বাড়ায় অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হওয়া অথবা স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর গর্ভধারণের কারণে অনেকে আত্মহত্যা করেন। তবে দেশে আবেগতাড়িত আত্মহত্যার পরিমাণ বেশি, এটি একটি মানসিক সমস্যা। প্রকৃতপক্ষে নিজেকে ধ্বংস করার ভেতর কোনো বীরত্ব নেই, নেই কোনো কৃতিত্ব। জীবনকে ভালোবাসতে হবে। জীবনের সমাধান জীবনের মধ্যেই নিহিত, আত্মহননের মধ্যে নয়।