পাঠক মত
যোগ্যতা ছাড়া ভিডিও কনটেন্ট তৈরির ঝোঁক
প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
জুবায়ের আহমেদ
বাংলাদেশে ফেসবুক ও ইউটিউব সহজলভ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত মিডিয়া বলতেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও বড় পর্দাকে বুঝাত। সেই সময়ে মানহীন অথবা যেনতেন কাজ করে টিকে থাকা যেমন তেমন মিডিয়াতে কাজ করার জন্য যোগ্যতা নেই, এমনটা মনে হলে কাজের সুযোগও পেত না অনেকে। ফলে ফেসবুক ও ইউটিউব সহজলভ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত নাটক, সিনেমা, সংবাদ পাঠক, উপস্থাপক অর্থাৎ ক্যামেরার সামনে মুখ দেখিয়ে কাজ করতে হয়, এমন পেশার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ সবকিছুর হিসেব মিলিয়ে নতুনমুখ নেওয়া হতো। যার মাধ্যমে বিনোদনপ্রেমী মানুষেরা ভালো কাজ দেখতে পারত।
ফেসবুক, ইউটিউব ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতার এই সময়ে ক্যামেরার সামনে কাজের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ধ্যান ধারণাই বলে যাচ্ছে মানুষের ভাইরাল হওয়ার নেশার কারণে। ফলে অভিনয় না জানা, ভুল উচ্চারণে অসম্পূর্ণ শব্দে কথা বলা হিরো আলমও আজ ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে পরিচিত। তিনি কিছু মানবিক কাজ করেন এবং নীতি কথা বলেন, এটিই এখন তার মূল আইডেন্টিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কাজের মাধ্যমে তিনি ভাইরাল হয়েছেন অর্থাৎ পেশাগত জায়গার অযোগ্যতার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি মানবিক। শুধু হিরো আলমই নন, অসংখ্য ব্যক্তি বাংলাদেশে ভুল উচ্চারণে, অসম্পূর্ণ শব্দে মানহীন আলোচনায় ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে মানুষের নেতিবাচক সমালোচনার মাধ্যমে পাওয়া ভিউকে কেন্দ্র করে আলোচিত হচ্ছে, যা সম্পূর্ণরূপে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে সব শ্রেণির মানুষের রুচির দুর্ভিক্ষের পরিচায়ক।
বাংলাদেশের নাগরিকদের দারিদ্রতা এবং বেকারত্ব এখনো চিন্তার বিষয়। বেকারত্ব ও দারিদ্রতার জন্য সাধারণ নাগরিকের প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার প্রয়োজন আছে। তবে বেকারত্ব দূরীরণের চিন্তার থেকেও ভাইরাল হওয়ার নেশায় আজকাল ভিডিও কনটেন্টের নামে মানসিক বিকারগ্রস্ততার প্রমাণ দিচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ, যারা প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে ভিডিও বস্নগ বানাচ্ছে। এটি এখন এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, কেউ বিপদে পড়লে তাকে সহায়তা না করে ভিডিও চিত্র ধারণ করার মাধ্যমে বস্নগ তৈরি করা হয়। লেখাপড়া নেই, উচ্চারণ শুদ্ধ নয় এমন মানুষজনও আজকাল নীতি কথার পসরা সাজিয়েছে বসেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় স্বামী-স্ত্রীর দৈনন্দিন জীবনযাপন, এমনকি বেডরুমের চালচলন-কথাবার্তাও কাপল-বস্নগের নামে প্রকাশ করা হচ্ছে।
মানুষের কল্যাণে আসে অথবা সুস্থ বিনোদন পাওয়া যায়, এমন বস্নগের প্রয়োজন আছে। ভাইসাবখ্যাত সামিউল হক ভূঁইয়ার বিনোদনমূলক কনটেন্ট অথবা দয়াল চন্দ্রের শিক্ষামূলক কনটেন্ট প্রয়োজন আছে। টিভিতে সংবাদ পাঠ কিংবা অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষিত, মার্জিত, শুদ্ধ উচ্চারণ জানা এবং ভালো বাচনভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তির প্রয়োজন হয়, তেমন যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি যদি মানুষের কল্যাণে বস্নগ করে সেটি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য, কিন্তু পড়ালেখা নেই, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান নেই, এমন ব্যক্তিও শুধুমাত্র টাকা দিয়ে আইডি-পেজে লাইক বাড়িয়ে মানহীন কনটেন্ট বানিয়ে মানুষের নেতিবাচক আলোচনাকে পুঁজি করে ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে টাকা ইনকামের নেশার ফলে বর্তমান প্রজন্ম চরম মানসিক বিকারগ্রস্ততার পরিচয় দিচ্ছে। ভিডিও কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও যথাযথ প্রস্তুতি না থাকার পরও ভিডিও বস্নগ তৈরি করতে গিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দিচ্ছে।
ভিডিও বস্নগের ক্ষেত্রে আরো একটি দুঃখজনক বিষয় এই যে, একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত থাকা বহু ব্যক্তি ভাইরাল হওয়ার নেশায় কিংবা বাড়তি অর্থ আয়ের ভাবনা থেকে ভিডিও বস্নগ তৈরি করার দিকে মনযোগী হতে গিয়ে মূল পেশা তথা স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় এই যে, নিউজের নামে ব্যাঙের ছাতার মতো জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন অথবা বিভিন্ন নামে পেজ খুলে টিভি নাম দিয়ে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে ভুল উচ্চারণ, অমার্জিত বাচনভঙ্গির মাধ্যমে সংবাদ পাঠ করে, এসব সংবাদের মাধ্যমে অনেকেই অবৈধভাবে লাভবান হয়ে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকেও কুলষিত করছে। চীনসহ বহু দেশের তরুণরা যেখানে যুগের চাহিদাসম্পন্ন পণ্য আবিষ্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে এবং নিজেরা সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশী তরুণ সহ সবশ্রেণির মানুষের ভিডিও কনটেন্ট তৈরির দিকে দাবিত হওয়া অশুভ লক্ষণ।
এইরূপ অবস্থায় মানহীন ভিডিও কনটেন্টের মহামারি রোধকল্পে ভিডিও কনটেন্ট এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা করা যোগ্যতাহীন কথিত নামধারী সাংবাদিক ও তাদের ফেসবুক পেজের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ নাগরিক কর্তৃক মানহীন কাজ করা বস্নগারদের বর্জন করতে হবে। যারা ভালো কনটেন্ট তৈরি করে তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র ভাইরাল হওয়ার নেশায় যোগ্যতা না থাকা স্বত্ত্ব্বেও বস্নগ তৈরি করা ব্যক্তিদের নিজেদের যোগ্যতা ও সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে হবে। টাকা উপার্জনের স্বাভাবিক বহু মাধ্যম আছে, পরিশ্রম করে সেসব মাধ্যমে কর্মে নিয়োজিত হতে হবে। ভিডিও কনটেন্ট সবার জন্য নয়, এটি যোগ্যতা সম্পন্ন ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাজ, এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। বর্তমানে ভিডিও কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এবং অর্থ আয়ের নেশায় সব শ্রেণির মানুষ যেভাবে ঝোঁকছে, এটি অব্যাহত থাকলে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম মানসিক বিকারগ্রস্ত প্রজন্ম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে অসুস্থ প্রজন্মের দেশ হিসেবে বিবেচিত হওয়াই হবে চূড়ান্ত পরিণতি।
জুবায়ের আহমেদ
শিক্ষার্থী
ডিপেস্নামা ইন জার্নালিজম
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)
কাটাবন, ঢাকা।