বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন থেকে তরুণ যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তরুণদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার কারণে এ বিষয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই তরুণদের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে নিজেকে প্রস্তুত করতে আহ্বান জানান। কোনো মতে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পড়াশোনা না করে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার আহ্বানও প্রধানমন্ত্রী অসংখ্যবার জানিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী সেদিকে মোটেও মনোযোগ দিচ্ছেন না। এমনকি অসংখ্য তরুণ যারা পড়াশোনা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে হতাশ এবং উদাসীন রয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ জরিপে ওঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই আছেন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে নেই। বাংলাদেশের ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার তিনগুণেরও বেশি মেয়েদের ক্ষেত্রে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার শতকার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিপরীতে ছেলেদের এই হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছেলে। মেয়েদের বাল্যবিয়ে, দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা কিংবা মূল্যস্ফীতির কারণেই তরুণদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উলেস্নখ পাওয়া যায়।
কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, মেয়েদের বাল্যবিয়ে, শিক্ষার মানে ঘাটতি, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়াসহ বেশ কিছু বিষয়কে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নারীদের বড় একটা অংশ গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নারীদের এই গৃহস্থালির কাজকে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করা যাচ্ছে না। ফলে এর পরিমাণ বেশি মনে হচ্ছে। আমাদের দেশে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ রয়েছে। তারপরও সামাজিক কারণে নারীর কাজকে গৃহস্থালির কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে নারী স্বাচ্ছন্দ্যে কাজে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।
তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কী করণীয়, সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকলেও ফলপ্রসূভাবে কোনো কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা এবং উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা সম্ভব না হলে দেশের জন্য আশানুরূপ উন্নয়ন সফলতা পাওয়া কঠিন হবে।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটির চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ যুবগোষ্ঠী। বাংলাদেশে তরুণরা সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো দেশের যুবসমাজ সেই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। যুবসমাজই একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। জনশুমারির প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা হ্রাস পেলেও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। আবার কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তরুণ-যুবরা। তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালে অবস্থান করছে। এখন দেখার বিষয় হলো কর্মক্ষম এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে সত্যিকার অর্থেই যথাযথ কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে কিনা।
বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যুবশক্তিকে যথাযথভাবে জনশক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়নি। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত যুবক প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া।
আমরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি। কিন্তু কীভাবে সেই উন্নয়ন হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হচ্ছে। এ নিয়ে আমরা বেশ আনন্দিত। এতে প্রচুর পরিমাণ স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি এতে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেই কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণের জন্য আমাদের দেশের যুবসম্প্রদায় কি যথেষ্ট প্রস্তুত আছে? তারা কি নিজেদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে পেরেছে? মূলত দক্ষ জনশক্তিই এ ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশীজন হতে পারে। শুধু সংখ্যা বিবেচনায় তরুণদের কাজে লাগানো মোটেও সম্ভব হবে না। সেসব যুবক কিংবা তরুণদের কাজে লাগানো যাবে, যারা মূলত দক্ষ।
দেশে যথেষ্ট পরিমাণ শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী থাকলেও তারা প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নের অংশীজন হওয়ার মতো দক্ষ নয়। যদিও ইতোমধ্যেই তরুণদের কাজে লাগাতে সরকার বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। শিক্ষায় জোর দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হচ্ছে। বিশেষ করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়। তারপরও তরুণ-যুবদের মনে সব সময়ই নানা ধরনের হতাশা, আশঙ্কা এবং উদাসীনতা দানা বেঁধে উঠেছে। তাদের নিজেদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পরিমাপে আত্মবিশ্বাসের সংকট রয়েছে। তাদের বিদ্যমান এই শঙ্কা ও হতাশা দূর করতে হলে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ননীতি বাস্তবায়ন করতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক খাতে যুবসমাজের জন্য শুধু বরাদ্দ বাড়ানো নয়, সেটির যথাযথ ব্যবহার করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
দেশের তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে, দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ এই তরুণগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রম্নততর এবং টেকসই করা সম্ভব। আর এ জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।
কিন্তু আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের কার্যকর অনুকূল পরিবেশ নেই। অন্যদিকে, সরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, এটি ঠিক। কিন্তু সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে দুর্নীতির হার বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যদি আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে অবশ্যই যুবসম্প্রদায়কে যথাযথ এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আন্তরিক দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ংঁষঃধহসধযসঁফ.ৎধহধ@মসধরষ.পড়স