শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির শিখরে অবস্থান করতে পারে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমাদের শিক্ষার হার ছিল খুবই নগণ্য। কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে, শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শিক্ষার হারও কিন্তু অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ যেখানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে দেশের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। এই যে দ্রম্নতগতিতে আমাদের সাক্ষরতার হার বেড়েছে তার পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর সরকার শিক্ষার হার বৃদ্ধির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। আমরা জানি, ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক শিরোনামে একটি আইন পাস হয়। আর ১ জানুয়ারি, ১৯৯২ সালে এই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা মাত্র ৬৮টির উপজেলায় চালু হয়। তবে এই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা দেশব্যাপী সম্প্রসারিত হয় ১ জানুয়ারি, ১৯৯৩ সালে। এর পাশাপাশি তখন থেকেই শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার জন্য উপবৃত্তি প্রদান, খাদ্য বিতরণ, বিনামূল্যে বই বিতরণসহ এ রকম নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অর্থাৎ সরকার তখন শিক্ষার্থীদের অনুকূলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে রেখেছিলেন। তাছাড়া অভিভাকরাও তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন। কারণ তখন তাদের আয়ও যেমন সীমিত ছিল ঠিক তেমনি শিক্ষা উপকরণের দামও তাদের নাগালের মধ্যেই ছিল।
আজকে আমি একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আর সেটি হলো আমাদের শিক্ষা উপকরণের দাম অনিয়ন্ত্রিত হারে বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে। চলতি বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড়ে মাথা পিছু আয় বলা হচ্ছে ২ হাজার ৮২৪ ডলার যা ২০২৩ সালে ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলারে। এদিক থেকে বলা যায় একদিকে যেমন মানুষের আয় বাড়ছে অন্যদিকে সমান তালে সবার ব্যয়ও বাড়ছে। বলা চলে আয়ের চেয়ে বর্তমানে কিন্তু মানুষের ব্যয়ই বেশি হচ্ছে। এই ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব, মৌসুমি বেকারত্ব ইত্যাদি। আর এ দাম বৃদ্ধির বাতাস যেন পুরোপুরি লেগেছে শিক্ষা উপকরণের ক্ষেত্রেও।
আমি আপনাদের সামনে শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধির কিছু চিত্র তুলে ধরছি। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার জন্য যে উপকরণগুলো দরকার তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কাগজ। বর্তমানে প্রতি রিম মোটামুটি মানের কাগজের মূল্য প্রায় ৬০০ টাকা; বছর খানেক আগে যেখানে দাম ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। প্রতি দিস্তা কাগজ আগে ২০ থেকে ২৫ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা করে। যদি আপনি আরও ভালোমানের কাগজ ক্রয় করতে চান তো আপনাকে আরও বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। এছাড়া আগে যে ছোট ছোট ১০ টাকা দামে সাদা খাতা পাওয়া যেত এখন আর তাও পাওয়া যাচ্ছে না। এবার আসুন আমরা একটু কলমের দামে নজর দেয়। আগে যেখানে ম্যাটাডোর হাইস্কুল কলম ছিল ৫ টাকা বর্তমানে সেটি বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা দামে। এছাড়া অলটাইম আর গুডলাক কলম আগে ৬ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭ টাকা করে। একইভাবে কালার পেন আর জেল পেনগুলো আগে ১০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে হচ্ছে ১২ টাকা করে। তবে পেন্সিল, রাবার এবং ইরেজার যথারীতি ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এই তো গেল খাতা-কলমের দামের চিত্র। এবার আমরা অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের দামের দিকে একটু নজর দিই। আগে যেখানে আমরা একটি নরমাল ক্যালকুলেটর ৬০ থেকে ৮০ টাকায় ক্রয় করতাম বর্তমানে সেটির বাজার মূল্য ১২০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরগুলোর মধ্যে যেটির দাম সবচেয়ে কম সেটি ২০০ থেকে ২৩০ টাকা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। আগে যেখানে আমরা একটি জ্যামিতি বক্স ৬০ টাকায় ক্রয় করতাম বর্তমানে সেটির দাম বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১০০ টাকা। এছাড়া আগের ৩০ টাকা, ৫০ টাকা দামের ফাইলগুলো আর বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলোর বাজার মূল্য ৫০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এখন আর আগের মতো ২০ টাকায় কিংবা ৩৫ টাকায় হার্ডবোর্ড পাওয়া যাচ্ছে না। একই মানের হার্ডবোর্ড ক্রয় করতে আপনাকে খরচ করতে হবে ৪০ থেকে ৬৫ টাকা পর্যন্ত।
ছোট্ট একটি গল্প বলি, যেহেতু আমি একজন গৃহ শিক্ষক সেহেতু আমি মোটামুটি সাধারণ পরিবারগুলোর অবস্থা ভালো করে আন্দাজ করতে পারি। আমার পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী রয়েছে। সে সবসময় একটি খাতায় সব বিষয়ের নোট লিখে। একদিন তাকে আমি বললাম যে তুমি আগামী ক্লাসে প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা খাতা বানিয়ে নেবে। কিন্তু পরবর্তী ক্লাসে দেখা গেল সে খাতা প্রস্তুত করেনি। আমি একটু রাগান্বিত স্বরে তাকে বললাম খাতা কেনো প্রস্তুত করোনি? তখন সে আমাকে উত্তর দিল স্যার খাতার অনেক দাম আম্মু কিনে দেননি। আম্মু বলেছেন, একটি খাতাতেই সব বিষয়ের নোট করতে। অর্থাৎ ইতোমধ্যেই সাধারণ পরিবারগুলোতে শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এরকম প্রতিটি শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে যা আমাদের শিক্ষার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। যেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খাচ্ছে সেখানে যদি এইভাবে শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পায় তখন দেখা যাবে সাধারণ পরিবারের সন্তানরা শিক্ষা থেকেই বঞ্চিত হবে। আসল কথা হচ্ছে আমাদের সমাজে যারা বিত্তবান শ্রেণির মানুষ আছেন তাদের কিন্তু এ রকম দাম বৃদ্ধিতে কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই দাম অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ইতোমধ্যেই অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এভাবে যদি শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেতেই থাকে তাহলে একসময় দেখা যাবে খেটে খাওয়া মানুষ আর তাদের সন্তানদের হয়তো স্কুলেই পাঠাবেন না। তাই এখনই আমাদের এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমাদের সরকারের উচিত শিক্ষা উপকরণের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তা না হলে একদিকে যেমন সাধারণ পরিবারগুলোর শিক্ষার প্রতি অনীহা চলে আসবে ঠিক তেমনি আমাদের সাক্ষরতার হারও কমতে থাকবে। যা আমাদের দেশের উন্নয়নের ধারায় অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।