বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে খুব পরিচিত একটি শব্দ হলো ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা। ইউনেস্কোর মতে, 'বিষণ্নতা হলো মানসিক স্বাস্থ্যগত একটি অবস্থা যা একটি মানসিক রোগ। বিষণ্নতা হালকা ও স্বল্পস্থায়ী বা গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। দীর্ঘদিন বিষণ্নতায় ভোগার কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বছরে সাত লাখের বেশি মানুষ বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন!' বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকটের তৈরি করতে যাচ্ছে এই বিষণ্নতা। নানা কারণেই মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য আক্রান্ত হয় অবসাদ, হতাশা আর দুশ্চিন্তায়। উপায় খুঁজতে গিয়েও যখন মেলে না মুক্তির পথ, তখন বিষণ্নগ্রস্ত মানুষটি হয়ে ওঠে জীবনবিমুখ। এ থেকে কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন একটি মারাত্মক ব্যাধি। এটি মানুষকে ধীরে ধীরে অক্ষমতার দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। জীবনের কোনো না কোনো সময়ে বা পর্যায়ে কম-বেশি স্ট্রেস, বিষণ্নতায় ভোগাটা স্বাভাবিক। তবে দীর্ঘদিন ধরে এটি চলতে থাকলে সুকর্ত হওয়া জরুরি। ডিপ্রেশন এমন একটি মেন্টাল ডিসঅর্ডার, যার কারণে মানুষের জীবন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতে পারে। বিষণ্নতা নামক এই মানসিক রোগটি আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। যা আগামীর জন্য একটি ভয়াবহ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার তার দেশের তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই আসে একটি জাতির পরিবর্তন। তরুণদের মেধা বিকাশের মাধ্যমে একটি জাতি সামনে এগিয়ে যায়, পৌঁছাতে পারে উন্নতির সর্বোচ্চ শিকড়ে কিন্তু বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়ানকভাবে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা এখন প্রায়ই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই ঝরে পড়া শুধু অভিভাবকই নয়, সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জন্য উৎকণ্ঠার, উদ্বেগের। আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করেছেন। গড়ে প্রতি মাসে ৪৫ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ১৩-১৯ বছর বয়সিদের মধ্যে, যারা মোট সংখ্যার ৬৭.৩ শতাংশ। এর মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ১৫৯ জন। বর্তমানে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা বেশি দেখা যায়। একাডেমিক পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে না পারা, পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারা কিংবা পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পাওয়া ইত্যাদি। এসব কারণেই সাধারণত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা বিরাজ করে থাকে। সম্প্র্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৭৪ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী বিভিন্ন পর্যায়ের বিষণ্নতায় ভুগছেন। এর মধ্যে মাঝারি ধরনের বিষণ্নতায় ২৬ শতাংশ, অত্যধিক বিষণ্নতায় ২৬ শতাংশ এবং ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী মারাত্মক পর্যায়ের বিষণ্নতায় ভুগছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন: মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বা গুরুতর ডিপ্রেশন, পার্সিস্ট্যান্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বা স্থায়ী ডিপ্রেশন, সাইকোটিক বা মানসিক ডিপ্রেশন। বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন কিনা তা বোঝার কিছু উপায় হচ্ছে, দিনের বেশিরভাগ সময়েই হতাশায় নিমজ্জিত থাকা। প্রতিদিন ক্লান্তি অনুভব করা। প্রায় সব কাজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। চোখে পড়ার মতো ওজন বাড়া বা কমে যাওয়া। অতিরিক্ত ঘুমানো কিংবা একদমই ঘুমাতে না পারা। চিন্তা-ভাবনা বা চলাচলে গতি ধীর হয়ে যাওয়া। নিজেকে মূল্যহীন লাগা বা অপরাধবোধে ভোগা। মনোযোগ হারিয়ে ফেলা বা সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা। বারবার মৃতু্য বা আত্মহত্যার কথা ভাবা। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে তরুণদের বিষণ্নতার বিশেষ কারণ। সোস্যাল মিডিয়ায় মানুষ যেমন একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারে সে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খবরাখবর দেখার পাশাপাশি নিজেদের আবেগ বহিঃপ্রকাশ করতে পারেন। সোস্যাল মিডিয়ায় যেমন সুবিধা আছে তেমনি ক্ষতিকর দিকও আছে। বর্তমান কিশোর-তরুণদের বড় একটি অংশ সোস্যাল মিডিয়ায় আসক্ত। সোস্যাল মিডিয়ায় আসক্ত থাকার কারণে বাস্তবজীবনে থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডুবে থাকছে একাকীত্বে। দীর্ঘদিন এভাবে একাকীত্বের কারণে তরুণরা বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিষণ্নতা যেহেতু একটি মানসিক রোগ তাই এটি থেকে নিরাময় পেতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সঠিক পরামর্শ বা কাউন্সিলিং নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া বিষণ্নতা নামক অভিশাপ থেকে তরুণদের রক্ষা করতে হলে তরুণদের মধ্যে বিষণ্নতা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার জন্য প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন মেডিটেশন করতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। বিষণ্নতা কাটাতে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা খুবই জরুরি। কাছের মানুষের সঙ্গে গল্প করলে বিষণ্নতা কমে যায়। বেশি বেশি বই পড়তে হবে এবং সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত রাখতে হবে। সমাজের সব নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিষণ্নতায় ভোগা মানুষদের শেয়ার করা পোস্টকে হাসি ঠাট্টা, বিরূপ না করে বরং তাদের সঠিক পরামর্শ, এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। বেশি রাত করে ঘুমানোর বদ অভ্যেস ত্যাগ করতে হবে, সব সময় ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমাদের সমাজ এবং তরুণ প্রজন্ম ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতামুক্ত হোক।
মোহাম্মদ হাসান
কলাম লেখক