মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
পাঠক মত

আমার স্মৃতিকথা

শফিকুল ইসলাম লেবু ঢাকা
  ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আমার স্মৃতিকথা

২৩ মার্চ '৭১ সন্ধ্যার পর পর উঠানে বিছানায় বসে সহপাঠী বন্ধু কয়েকজনে একসঙ্গে খেলছিলাম। হঠাৎ পশ্চিম-দক্ষিণে দেখি আগুন, কালো ধুয়া উড়ছে আর উড়ছে, আমি দৌড়ে এসে বললাম, আব্বা ওইদিকে আগুন কেন? মাকে উদ্দেশে করে হাত তুলে ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে আব্বা বলে যুদ্ধ বুঝি শুরু হয়ে গেছে! মোহম্মদপুর জেনেভা বিহারি কেম্পে মুক্তিবাহিনী আগুন ধরিয়েছে শেখ সাহেবের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে দেশে এই বুঝি যুদ্ধ শুরু হলো! আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে না, সময় কম গ্রামের উদ্দেশ্যে সবাইকে দ্রম্নত সময়ে প্রস্তুত হতে বললেন কোনো গাড়ি বা যানবাহন কিছুই নেই রওনা দিতে হবে পায়ে হেঁটে হেঁটে। বাসায় বয়স্ক একজন লোক ছিল বয়স ৭৫ বা তার চেয়েও বেশি, মা বলেন, মুরুব্বি কিভাবে যাবেন? সম্ভবত লোকটা বাসায় থাকত, কিন্তু আমাদের কোনো আত্মীয় নন! সিদ্ধান্ত হলো তাকে রেখেই আমরা যাব। সবার মন খারাপ, উনাকে রেখে গেলে পাকিস্তানিরা লোকটাকে মেরে ফেলবে! আবার আমাদের সঙ্গে নিলেও বিপদ! আমাদের সঙ্গে হেঁটেও যেতে পারবে না তখন বয়স্ক লোকটি নিজেই বললেন, আমি থেকে যাই তোমরা দ্রম্নত যাও। জরুরি ভিত্তিতে গোছগাছ শুরু করল, ঘরের মধ্যে মাটির নিচে কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র পুঁতে রেখে গেল, যদি দেশ স্বাধীন হয়, কাজে লাগবে। যদি আমরা বেঁচে থাকি তবে! যথারীতি গ্রামের বাড়ি রওনা হলাম।

ঢাকা জেলার কাছেই দোহার গ্রাম চলিস্নশ কিলোমিটার হবে হয়ত! মা বলে আমার এইটুকু ছেলে সে কি পারবে হেঁটে যেতে? কোলে ছিল আমার আরেক ভাই, মা তাকে কোলে নিল, আব্বা বড় একটি ব্যাগ বহন করলেন আমরা এবং কিছু প্রতিবেশীসহ সন্ধ্যায় ঢাকা হতে পশ্চিম দিকে হাঁটা শুরু করলাম, আমি হাফ পেন্ট গেঞ্জি পরা ছিলাম, আমার হাতে কিছু ছিল মনে নেই কি ছিল তাতে! মাঝপথে কোন এক মসজিদে আমরা বিশ্রাম নেই, কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই, আমি অবুঝ কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই মা বলে কোন শব্দ কান্না করলে সবাই মারা যাব মা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে জানি না কতক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।

আবার হাঁটা শুরু করলাম সামনে নদী পড়ল পার হতে হবে, অনেক লোক তীরে দাঁড়িয়ে আছে অবশেষে নৌকা তীরে আসল সবাই নৌকা উঠে বসে আছে কোন শব্দ নেই দ্রম্নত মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল, ভরা যাত্রী কিন্তু নৌকা বেশ দূরে চলেও গেল মা আব্বাকে বলল আমার বাজান কই? আমি নৌকায় নেই, মা সে কি কান্না! আমাকে উঠাতে পারেনি,আমি কি হারিয়ে যাব? আমাকে কি পাবে এত লোকের মাঝে? মা আব্বার ভিষণ চিন্তায় পড়ে গেল! কি হবে যুদ্ধ লেগেছে তারাহুরা বাড়ি যেতে হবে সবার একই চিন্তা দ্রম্নত পৌঁছানো আমি তখন দেখি নৌকা চলে যায়, আমাকে ফেলে গেলে আমি যাব কিভাবে মনে আসল ভাবনা ও কান্না, তখনই আমি সব শক্তি দিয়ে প্রচন্ড জোরে চিৎকার দেই 'মা' বলে, মা আমাকে নিবা না? মা আমি এখানে, নৌকা আর পাড়ে ফেরত আসেনি, মাঝি বলল অপর নৌকার মাঝিকে ওই বাবুটাকে তোমার নৌকায় আনবে অন্য নৌকায় অপেক্ষারত যাত্রীরা আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে আসলেন। আব্বা-মা আমার জন্য কান্না করছিলেন। পথযাত্রীরা আমাকে আব্বার হাতে তুলে দিলেন; মা আব্বা আমাকে জরিয়ে অনেক কান্না করে, আমিও রাগ করি আমাকে ফেলে আসলে কেন? আমি অনেক কান্না করি আমার সঙ্গে মাও কাঁদেন, শুনেছি যুদ্ধে, ওই সময় কত বাচ্চা হারিয়েছে! আমি হেঁটে হেঁটেই বাড়ি পৌঁছাই যুদ্ধের সময় বয়স হবে চার, যুদ্ধের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। লোকমুখে শোনা মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের আগুনে আকাশ লাল হয়ে যায়।

অবশেষে যখন দেশ স্বাধীন হলো আব্বা সরকারি চাকরি করতেন কাজের প্রয়োজনে ঢাকা আসতে হলো বাসায় এসে দেখেন বয়স্ক লোকটি বেঁচে আছেন কিন্তু পাকিস্তানিরা আমার নানাকে খুঁজে। কারণ যুদ্ধের কিছুদিন আগে তারা পানি চাইতে আসলে নানা পানি দিয়ে সাহায্য করেননি, সেই কারণে হানাদারদের একটা জিত ছিল নানাকে ধরে নেওয়ার জন্য। আমাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর 'দোহার' গ্রামের খালপাড় দিয়ে ছোট ছোট পতাকা হাতে দলবেঁধে মুক্তিযাদ্ধারা জয়বাংলা জয়বাংলা স্স্নোগানে মুখর গ্রামের সেই মিছিলের পেছনে পতাকা হাতে ছোট শিশু বালক আমিও ছিলাম আনন্দের স্বাধীনতার জয়গানে।

শফিকুল ইসলাম লেবু

ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে