মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বাংলাদেশ যেভাবে পরিবেশ দূষণের শীর্ষে

পরিবেশ আমাদের, আমাদের বেঁচে থাকার জায়গা, পরিবেশের ক্ষতি করা হলো নিজের ও নিজের আশপাশের সবার ক্ষতি করার সমান। তাই পরিবেশ রক্ষার্থে ও দূষণ রোধে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
মিনহাজুর রহমান মাহিম
  ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশ যেভাবে পরিবেশ দূষণের শীর্ষে

মাটি, পানি, বায়ু, শব্দ, আলো সব ধরনের দূষণ একত্রিত হয়ে পরিবেশ দূষণ হয়ে থাকে। বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া এক তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে ২০১৫ সালে পরিবেশ দূষণের কারণে ৮০ হাজার মানুষের মৃতু্য হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃতু্য হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। বাংলাদেশের পরিবেশ এতটা দূষিত যে, বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস গ্রহণ করে থাকে। ২০২৩ সালের আইকিউএয়ার-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাসের দেশ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেধে দেওয়া মানের চেয়ে ১৫ গুণের বেশি পিএম পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশের বাতাসে। পিএম হলো পার্টিকুলেট ম্যাটার, যেটি দ্বারা বোঝা যায় বাতাসে ভাসমান কঠিন বা তরল পদার্থের ক্ষুদ্র কণার মিশ্রণের পরিমাণ। ধুলো, ধোঁয়া, ছাই, ধাতব কণা, জৈব পদার্থ, বনভূমি দাহ, আগ্নেয়গিরি, ঝড়, ধুলো ঝড়, যানবাহন, কলকারখানা, বিদু্যৎ কেন্দ্র, ইটভাটা, কৃষি, নির্মাণ কাজসহ ইত্যাদি কারণে বাতাসে পিএম বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা জেলা পৃথিবীর দ্বিতীয়তম দূষিত শহর, প্রথমে রয়েছে ভারতের নয়াদিলিস্ন। বাংলাদেশের বায়ু দূষণের পিছনে অসংখ্য কারণ রয়েছে। সাধারণত ঢাকায় চলাচল করা যানবাহনের ৮০% বাস এক যুগের বেশি পুরনো, উক্ত যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত ধোঁয়া মারাত্মকভাবে বায়ু দূষণ করে থাকে। এছাড়াও যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, রাস্তাঘাটের অতিরিক্ত যানজট বায়ু দূষণ বৃদ্ধির পিছনে দায়ী। ২০২৩ সালের ৩১-এ জানুয়ারি পরিবেশ মন্ত্রীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৮,০০০ ইট ভাটা রয়েছে, যার ৬০% অবৈধ। অবৈধ ইট ভাটাগুলো পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই বছরের পর বছর চলছে, নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারসহ আরও নানা মাধ্যমে এসব ইট ভাটা মারাত্মকভাবে বায়ু দূষণ করছে। এছাড়াও মন্ত্রী আরও জানান যে, বাংলাদেশের শহরগুলোতে দৈনিক প্রায় ৩০ হাজার কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যেটি আগামী ২০২৫ সালে ৪৭ হাজারে উন্নীত হবে এবং এসব কঠিন বর্জ্যের ১০ শতাংশই পস্নাস্টিকজাত। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার কলকারখানা রয়েছে। অধিকাংশ কলকারখানায় পুরনো ও অনুন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারের কারণে নির্গত ধোঁয়া ও ধূলিকণা, বিভিন্ন রাসায়নিক গ্যাস, যেমন কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন-অক্সাইড ইত্যাদি বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজের কারণে নির্মাণ সাইট থেকে ধূলোবালি, ভবন ভাঙার ধুলো মারাত্মকভাবে দূষণ সৃষ্টি করে থাকে। কাঠ, কয়লা, কেরোসিনসহ ইত্যাদি অপরিমার্জিত জৈব জ্বালানি ব্যবহার, গ্রামাঞ্চলে জৈব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বায়ু দূষণ সৃষ্টি করছে। এছাড়াও বন উজাড়, কৃষি কাজ, অপরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ আইনের শিথিল প্রয়োগ বায়ু দূষণের পিছনে দায়ী। বায়ু দূষণের কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে; যথা শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, অ্যালার্জি ইত্যাদি। এছাড়াও বায়ু দূষণের কারণে মারাত্মকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে থাকে।

পানি দূষণ পরিবেশ দূষণের পিছনে একটি অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে নানাভাবে পানি দূষণ হয়ে থাকে। তন্মধ্যে শিল্পকারখানা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কলকারখানার বর্জ্য পানিতে প্রত্যক্ষভাবে ফেলা পানি দূষণের পিছে মারাত্মকভাবে দায়ী। কারখানার রাসায়নিক পদার্থ, ভারী ধাতু, তেল এবং রঞ্জক পানিতে মিশে পানি দূষণ সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়াও শিল্পকারখানাগুলোর ত্রম্নটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পানি দূষণ হয়ে থাকে। কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে কীটনাশক, সার, এবং রাসায়নিক উপাদান এবং কৃষি ক্ষেত থেকে বর্জ্য পানিতে মিশে পানি দূষণ করছে। এছাড়াও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব, অপরিকল্পিত ও অপরিচ্ছন্ন শহরাঞ্চল, কঠিন বর্জ্য পানিতে ফেলা, যানবাহনের তেল ও রাসায়নিক পানিতে মিশে যাওয়া, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ফলে পানি দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, জলাভূমি ভরাট, পানি ব্যবহারের অসচেতনতা, নদীতে চলমান যানের ময়লা-আবর্জনা পানিতে ফেলা, নদীর পাশে তৈরি হওয়া বাজারের সব বর্জ্য নদীতে ফেলাসহ ইত্যাদি কারণে মারাত্মকভাবে পানি দূষণের সৃষ্টি হয়ে থাকে। পানি দূষণের কারণে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ হয়ে থাকে; যথা ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড এবং দূষিত পানিতে এডিস, অ্যানোফিলিস মশার জন্ম হয়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়াসহ ইত্যাদি মশাবাহিত রোগও পানি দূষণের কারণে হয়ে থাকে। এমনকি দূষিত পানি পানের ফলে জন্ডিস হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও পানি দূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য হ্রাস, জলজ প্রাণীর বিলুপ্তি, কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়াসহ আরও নানা ক্ষতি হয় এবং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পরিবেশ দূষণের আরেকটি অংশ হলো শব্দ দূষণ, যা বাংলাদেশের একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। বাংলাদেশে শব্দ দূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা, যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নানা কারণে শব্দ দূষণ হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তন্মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং যানবাহন বৃদ্ধির কারণে শব্দ দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়াই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার, সাইলেন্সারবিহীন মটর বাইক, যানজটের কারণে মারাত্মক শব্দ দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। শিল্প কারখানাগুলোতে অনুন্নত ও ত্রম্নটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও আবাসিক এলাকার কাছে কারখানা গড়ে উঠাও শব্দ দূষণ করে থাকে। এছাড়াও নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, বিবাহ, মিলাদ, রাজনৈতিক সমাবেশে ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে মাইক ও স্পিকার বাজানো ও বহু জায়গায় বিদু্যৎ বিভ্রাটের কারণে জেনারেটরের ব্যবহারের কারণেও মারাত্মক শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয়ে থাকে। শব্দ দূষণের কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের ক্ষতিই হয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চশব্দের সংস্পর্শে থাকলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিরক্তি ও মারাত্মক ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। যা শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের ক্ষতিরই কারণ। শুধু মানুষই না, বরং শব্দ দূষণের কারণে পাখিসহ অন্য প্রাণীরাও মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে।

ক্রমশ পরিবেশ দূষণের বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ হলো অতিরিক্ত মাটি দূষণ হওয়া। মাটি দূষণের ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। আমরা প্রতিনিয়ত পস্নাস্টিক ও পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে মারাত্মকভাবে মাটি দূষণ করে থাকি। এছাড়াও শিল্পকারখানার বর্জ্য, কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার, বন উজাড় এবং সহজে পচে না এমন ময়লা মাটিতে ফেলা মাটি দূষণের অন্যতম কারণ। মাটি দূষণের ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ফসল উৎপাদন কমে যায়। এছাড়াও মাটি দূষণের কারণে দূষিত মাটিতে উৎপাদিত খাবার মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। মাটি দূষণের ফলে জীব বৈচিত্র্য হ্রাস, পানি দূষণসহ পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে থাকে।

আমাদের দেশ ও পৃথিবীতে ক্রমশ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়া আরেকটি দূষণ হলো আলোক দূষণ। অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার আনন্দ ও আধুনিকতার ছাপ মনে করা হলেও নীরব ঘাতকের মতো অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার মারাত্মকভাবে মানুষসহ পরিবেশের অন্য প্রাণীদের ক্ষতি করে যাচ্ছে। অতিরিক্ত আলো ব্যবহারের কারণে মানুষের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ঘুমের ব্যাঘাত হয়ে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বাড়ছে। আলো দূষণের কারণে পাখি ও অন্য প্রাণীদের ক্ষতিসহ মহাকাশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায়ও বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে।

উক্ত সব ধরনের দূষণ রোধে একটি রাষ্ট্রের জনগণ ও সরকার সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। বায়ু, মাটি, পানি, শব্দ ও আলো দূষণ রোধে যানবাহনের ধোঁয়া কমানো, কালো ধোঁয়া নির্গমন হয় এমন যানবাহন বন্ধ করা, কলকারখানা থেকে নির্গমন হওয়া ক্ষতিকারক ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ এবং এ ব্যাপারে কঠোর আইন প্রয়োগ, জৈব জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে এনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার, ইটভাটার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণ সাইটের ধুলো নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন, পানি দূষণ রোধে কলকারখানার বর্জ্য পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলা, মানুষের বর্জ্য পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশন করা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধি করা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলাভূমি রক্ষা করা, শব্দ দূষণ রোধে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করা, সাইলেন্সারবিহীন মটর বাইক জব্দ করা, আবাসিক এরিয়াতে শিল্পকারখানা বন্ধ করা, শিল্পকারখানাগুলোতে উন্নত যন্ত্রের ব্যবহার ও পুরাতন যন্ত্রের সংস্কার নিশ্চিত করা, মাটি দূষণ রোধে পস্নাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করে পাটজাতীয় পণ্যের ব্যবহার, নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফালানো, আলো দূষণ রোধে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আলো ব্যবহার না করা, আলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন করে আলো অপচয় রোধ করা, এলইডি আলোর মতো উন্নত আলো ব্যবহার করাসহ সব ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

পরিবেশ আমাদের, আমাদের বেঁচে থাকার জায়গা, পরিবেশের ক্ষতি করা হলো নিজের ও নিজের আশপাশের সবার ক্ষতি করার সমান। তাই পরিবেশ রক্ষার্থে ও দূষণ রোধে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে পারে।

মিনহাজুর রহমান মাহিম : নবীন কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে