'প্রতিটি লেখকের হৃদয়ে ভেতরে একটি কলম থাকে, অথবা তার হৃদয় যেন কলম- সেই কলমটি লিখে যায় অবিরাম। 'হৃদয়' বলতে আমরা বুকের বাঁ দিকটা দেখিয়ে থাকি, সেই বাঁ দিকে আছে হৃদপিন্ড যার কাজ দূষিত রক্তকে শোধন করে সমস্ত শরীরে পাঠানো। ...হৃদয়ের ভেতরে যে কলমের অস্তিত্ব আমি অনুভব করি, সেই কলম আসলে আমাদের রক্তের অন্তর্গত একটি কলম, অথবা রক্তই সেই কলম। রক্ত যে কথা কয় তা কৃত্রিম কিংবা অসত্য হতে পারে না।' সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত 'হৃৎকলমের টানে' যখন সংকলিত হয়ে বই আকারে বের হয় ১৯৯০ সালে, তখন সৈয়দ হক প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় হৃদয় হরণ করা এই কথাগুলো লিখেছিলেন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ তার থেকেও ক্ষুদ্র একজন লেখক। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না, তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল একবার যশোরের একটি হোটেলে। দু'হাজার সাতের কোনো এক শীতের বিকালে। এ দেখাকে পরিচয় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না। যশোর শহরের ১৫ নম্বর কেশব লাল সড়কের হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনেলের লবিতে আমি তাকে থামিয়েছিলাম। তিনি দোতালা থেকে নিচে নামছিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তিনি থামেন এবং আমার সঙ্গে মিনিট পনের কথাও বললেন। এত সাহস কোথায় সঞ্চয় করে রেখেছিলাম? ভাবলে অবাক হই এখন। আমার নিজের লেখালেখিতে দাড়ি বা ফুলস্টপ টেনেছি। আমি যে কোনো এক সময় শৈশব, কৈশোর, প্রাক-যৌবনে কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করতাম, সে কথা বলার সাহস হয়নি। হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বিস্ময় নিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কোনো কথা আসে না মস্তকে। সৈয়দ হকের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তার লেখা উপন্যাস 'বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ' এবং সংবাদে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত 'হৃৎকলমের টানে' নিয়ে। তাকে কেমন করে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসি, 'সেই পাখির ডাক কী এখনও শুনতে পান?' তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং উত্তর দিয়েছিলেন, 'সেই পাখির ডাক আমৃতু্য শুনে যাব।' কোনো পাখির ডাক? 'হৃৎকলমের টানে'র কোনো এক সপ্তাহে সৈয়দ হক তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় কী অসাধারণ কথা লিখেছিলেন। মানুষের হয়ে, প্রকৃতির হয়ে, বিবেকের হয়ে একটি পাখি তাকে ডেকে যায় নিয়ত। ক্রমাগত বলে যায়, 'শুনছ? শুনছ? শুনছ?' এ কথাটির উপস্থাপনা এত শক্তিশালী ও হৃদয়ের তন্ত্রীতে ডাক পাঠানোর মতো ছিল যে, যারা লেখাটি পড়েছেন তারাও সে ডাক যেন শুনতে পেতেন। ১৯৮৬ সালে তিনি শুরু করেন তার এই বিখ্যাত কলাম। অবরুদ্ধ দেশে তিনি প্রতীকীভাবে মানুষকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিলেন। হোটেলের লবিতে তিনি বলেছিলেন, 'জেগে ওঠার ডাক যে লেখক সারা জীবন শুনতে পাবে না, তার সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।' বয়ে চলা মহাকালের ঘড়িতে পনের মিনিট খুব কম সময়। সেই সময়ে যদি সৈয়দ হকের মতো মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় তাহলে সময়টি প্রকৃত অর্থে হিরন্ময় হয়ে ওঠে। তাকে কিছুই বলতে পারিনি, তার লেখার প্রতি মুগ্ধতা, প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা এসব কথা কিছুই বলা হয়নি। তার পরেও তার জেগে ওঠার ডাক আমি শুনতে পাই। আমার একটি বিশ্বাসের কথা তার সঙ্গে আলোচনা করলে আমি তৃপ্তি পেতাম। কথাটি হলো, প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের হৃদয়ে একটি নিষ্পাপ এবং কৌতূহলী শিশু বাস করে। সে শিশু সারা দিন লেখককে অবিরত প্রশ্ন করে যায়। সে প্রশ্ন যদি লেখক শুনতে না পান, স্থবিরতা তাকে পেয়ে বসবে। লেখকের শব্দের ব্যবহার, রূপকল্প, কাব্যময়তা সব কিছু এক ঘেয়ে হয়ে যাবে। তিনি সারা জীবন একই কথা লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। চিন্তার বৈচিত্র্য হারিয়ে সর্বহারা লেখকে পরিণত হবেন। মনের ভেতরে শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়। সে কাজে ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত লেখক সত্তার মৃতু্য হয়। আমার এ বিশ্বাস কী সত্যি? সৈয়দ হকের সঙ্গে যদি অন্য কোথায়, অন্য কোনোখানে কিংবা মেঘের ভেলায় আকাশে দেখা হয়ে যায়, তাহলে তাকে সে প্রশ্ন করা হবে। মনে হয় 'জেগে ওঠার ডাক দেয়া' পাখি আর বুকের ভেতরে বসত করা শিশু আসলে এক ও অভিন্ন। এক একজনের এক এক রকম উপলব্ধি। আমি জানি না, আমি জানি না! আমি যা বললাম তা কী সত্যি। সত্যি মিথ্যা, মিথ্যা সত্যি। উপলব্ধির কী সত্যি মিথ্যা আছে, তাও বলা বড় কঠিন।
তবে একটি বিষয়ে মনে হয়, সবাই ঐক্যমত্য পোষণ করবেন তাহলো মানবিক মানুষের মনের ভেতরে একটি অদৃশ্য বিবেকের বসতি আছে। বিবেক শক্তিশালী হয় কখনো কখনো জ্ঞান দিয়ে। জ্ঞান সিক্ত বিবেকের সঙ্গে যুক্তি ও ইতিবাচক আবেগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়ে যায়। বিবেক যখন শক্তিশালী হয় বিবেচনাবোধ তখন প্রখর হয়ে যায়। বিবেক আর বিবেচনা কিন্তু সমার্থক শব্দ নয়। সংবেদনশীল বিবেক থেকে বিবেচনার জন্ম হয়। এ রকম বিবেচনা সব সময় ইতিবাচক হতে বাধ্য। বিবেককে জাগ্রত করতে হলে এর পরিচর্যা করতে হয়। আর একটি কথা বলা যায়, শুধু জ্ঞান দ্বারাই বিবেককে পরিপুষ্ঠ করা যায় না। যদিও এ লেখাটিতে একবার জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে; তারপরও 'ভালোবাসা' বিবেক বিকাশের আর একটি শক্তিশালী উপাদান। তাই শক্তিশালী বিবেকের বসতি সব শ্রেণির মানুষের হৃদয়ে থাকতে পারে। ওই যে বিবেকবোধ থেকে জাগ্রত বিবেচনা, এর থেকেই সব শ্রেণির মানুষ একাত্তরে আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের হাতিয়ার কী ছিল? দেশপ্রেম অবশ্যই। জনতা জেগে ওঠে কথাটির অর্থ হলো বিবেকবোধ তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়। জনতা যখন জেগে ওঠে তখন নিবেদন হয় সর্বোচ্চ মাত্রায়। মাতৃভূমি রক্ষায় পিপীলিকার মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠাবোধ করে না। ভয়াবহ মারণাস্ত্র তখন তাদের কাছে খেলনা হয়ে যায়। জনতার জেগে ওঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে ভিয়েতনামে, চীন, মার্কিন বলয়ের নিষ্ঠুর রাষ্ট্র নেতারা দেখেছেন একাত্তর সালে বাংলাদেশে। আর পাকিস্তানি বাহিনী লাঠি এবং সামান্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে বাঙালির সাহস দেখে বিস্মিত হয়েছে, আর বিস্মিত হয়েছে সমগ্র বিশ্ব। ওই যে কালজয়ী সেই সংগীতের মত, 'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।'
সৈয়দ শামসুল হককে পাখি নিয়ত ডেকে যেত, মানুষের হয়ে, প্রকৃতির হয়ে, বিবেকের হয়ে ক্রমাগত বলে যেত, "শুনছ? শুনছ? শুনছ?" সেই পাখি এখন আর আমাদেরকে কোনোভাবেই ডাক দিয়ে যায় না। পাখির ডাকে বিবেক জেগে ওঠে না। তাই আমাদের বিবেচনাবোধের অস্তিত্ব কখনো কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। পাখির ডাক শুধু শুনতে পায় ক্ষেত মজুর, পোশাক শ্রমিক, গভীর সমুদ্রে যারা জীবন বাজি রেখে মাছ ধরতে যায় সেসব মানুষেরা, যাদের পুঁজি শুধু দেহ, তাদের বিবেকবোধই শুধু জাগ্রত আছে। ওই যে এত বড় করোনা মহামারী গেল বাজারে কখনো খাদ্য দ্রব্যের জোগান কম হয়েছে? সারা বিশ্বের মানুষ কতটুকু হাহাকার করেছে জানি না। তবে এই সুবর্ণ পলির দেশে আমাদের কৃষক, শ্রমিকেরা আমাদেরকে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে দেননি, তবে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা তখনো টাকা পাচার করেছে। বিশ টাকার বালিশ বিশ হাজার টাকায় কিনেছে, বিক্রি করেছে। করোনার টীকা জালিয়াতি করেছে। লুণ্ঠন থেমে থাকেনি, এখনো থেমে নেই। পাখি আর মানুষের বিবেককে জেগে তুলে না। মনের ভেতরের নিষ্পাপ শিশু প্রশ্ন করে না। সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, মানুষে মানুষে বৈষম্য এসব বিষয় নিয়ে এখন আর কেউ রাজপথে কথা বলে না। ভয়াবহ এক নীরবতার সংস্কৃতি আমাদেরকে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে।
এক সময়ের তেরশ' নদীতে ঘেরা বাংলাদেশের নদীগুলো যেমন দখল হয়ে যাচ্ছে, অচেতন হয়ে যাচ্ছে প্রায়, জাতির অন্তরের গহীনে থাকা দেশপ্রেমও ঠিক সেভাবে চৈত্র মাসে খরাপীড়িত নদীর স্পন্দনহীন, ঢেউহীন এক ধরনের চেতনায় পরিণত হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা যদি বুদ্ধিবিক্রেতা হয়ে যান, পদক পদবী, পদের খোঁজে নিজেদেরকে ডুবিয়ে রাখেন তাহলে জাতির বিবেক তো দিকনির্দেশনার অভাবে মৃতপ্রায় নদীর মতো হয়ে যাবে। হয়েছেও তাই। ঝলমলে পথ হয়েছে, প্রাসাদোপম বাড়ি হয়েছে কিছু মানুষের। দেশ-বিদেশে অর্থ বিত্তের কোনো অভাব নেই, তবে বিবেক বিবেচনা মৃতবত।
পরিপূর্ণ হতাশ হওয়ার কিছু নেই আমাদের খেটে খাওয়া মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের নীতি-নৈতিকতা দেশপ্রেমের কোনো অভাব নেই। অধিকাংশ মানুষের মনের ভেতরের পাখি যখন এক সঙ্গে ডেকে উঠবে তখন আবার নদীতে জোয়ার আসবে, খড়কুটো যারা আমাদের এই অসাধারণ সুন্দর দেশটিকে এগিয়ে যেতে বাঁধা সৃষ্টি করছে তারাও স্রোতের তোড়ে ভেসে যাবে। আমরা আশাবাদী। আমরা বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম, দেশের সব মানুষকে সমতালে, সমলয়ে, সমপদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য।
শেখর ভট্টাচার্য : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক