বাংলাদেশ-নেপালের যুগান্তকারী বিদু্যৎ চুক্তি
নেপাল থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে জ্বালানি পাঠানোর জন্য নেপাল ও বাংলাদেশের দীর্ঘ ও একটানা কাজ দুই দেশের মধ্যে সক্রিয় বিদু্যৎ কূটনীতির ইঙ্গিত দেয়। আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক উভয়ের পারস্পরিক সুবিধার জন্য এটি আরও শক্তিশালী করতে হবে।
প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মো. সাখাওয়াত হোসেন
দক্ষিণ এশীয় নিকটতম প্রতিবেশী নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নেপাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, নেপাল ছিল প্রথমসারির দেশ- যারা বাংলাদেশকে একটি নতুন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নেপাল ও বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এরপর উভয় দেশ শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়, বিভিন্ন আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক এবং বহুপক্ষীয় ফোরাম সম্পর্ককও আরও প্রশস্ত ও মজবুত করে। নেপাল এবং বাংলাদেশ সার্ক এবং বিমসটেকের সদস্য এবং তারা বিবিআইএন-এ একসঙ্গে কাজ করে। দুই দেশ অভিন্ন স্বার্থ, মূল্যবোধ এবং বিষয়বস্তু ভাগ করে নেয়।
এই বছর দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক, পরিবহণ, সংযোগ, ট্রানজিট, বিনিয়োগ এবং জ্বালানি সহযোগিতায় রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে কাকরভিট্ট-ফুলবাড়ী-বাংলাবান্ধা ট্রানজিট রুটের উদ্বোধন এই সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। নেপালকে মংলায় বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। তাছাড়া, বাংলাদেশ রোহনপুর (বাংলাদেশ)-সিংগাবাদ (ভারত) হয়ে নেপালে একটি অতিরিক্ত রেল ট্রানজিট করিডোরও দিয়েছে। এখন এই দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও ট্রানজিট সম্পর্ক শক্তি রপ্তানি-আমদানি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। গত দুই দশকে এই দুই দেশের মধ্যে উত্থাপিত প্রধান ইসু্যগুলোর মধ্যে একটি হল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিদু্যৎ কূটনীতি। মজার বিষয় হলো, এই জ্বালানি সমস্যাগুলো উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ দখল করেছে। উদাহরণ স্বরূপ; নেপালের নির্বাচনের সময়, রাজনৈতিক দলের নেতারা জনগণের সামনে বক্তৃতা দিয়ে বলেছিলেন যে, নেপাল ভারতীয় রুট দিয়ে বাংলাদেশে বিদু্যৎ সরবরাহ করবে এবং এটি অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
সম্প্রতি নেপাল ও বাংলাদেশ বিদু্যতের শুল্ক নিয়ে একটি যুগান্তকারী চুক্তিতে পৌঁছেছে- যা বর্ধিত সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সুবিধার পথ প্রশস্ত করেছে। দুই দেশের জ্বালানি সচিবদের উপস্থিতিতে সিঙ্গাপুরে বিশ্বব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিবাচক পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথোরিটি (এনইএ) এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) চুক্তিটি চূড়ান্ত করার জন্য তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসার দাবিদার- যা বিদু্যৎ সহযোগিতায় একটি নতুন যুগের সূচনা করতে প্রস্তুত। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশে ৪০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ রপ্তানি করবে নেপাল। শুল্ক আলোচনায় দুই দেশ সম্মত হয়েছে যে বিদু্যতের ক্রয়-বিক্রয় মার্কিন ডলারে পরিচালিত হবে। যেহেতু চুক্তিটি বাংলাদেশে নেপালের উদ্বৃত্ত বিদু্যৎ রপ্তানির পথ প্রশস্ত করেছে, এটি নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করে, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করবে।
এনইএ টিমের আলোচনার সময় প্রস্তাবিত হারের সঙ্গে একমত হওয়া বিক্রির হার, প্রতি ইউনিট ৮ থেকে ৯ টাকার মধ্যে। এটি প্রতি ইউনিট ৬.২৫ থেকে ৬.৫ ইউএস সেন্টের মধ্যে পড়ে- যা উভয় দেশের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক এবং অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর ব্যবস্থা প্রদান করে। এই হার একটি ভারসাম্যকে নিশ্চিত করে- যা রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারক উভয় দেশকে উপকৃত করবে, সামনের দিনগুলোতে একটি ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই বিদু্যৎ বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। নেপালের বর্তমান লক্ষ্য হলো তার বিপুল জলবিদু্যৎ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো এবং দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে ভারত ও বাংলাদেশে উদ্বৃত্ত শক্তি রপ্তানি করা। এটি ৪ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত ভারতের সঙ্গে নেপালের দীর্ঘমেয়াদি বিদু্যৎ বাণিজ্য চুক্তিতে প্রতিফলিত হয়। নেপালের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি হলো তার বিদু্যতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো এবং আঞ্চলিক পাওয়ার গ্রিডে অবদান রাখা, দক্ষিণ এশীয় বিদু্যতের গতিশীলতায় দেশটির ভূমিকাকে শক্তিশালী করা। এই বিষয়ে, নেপালের সঙ্গে চুক্তিটি বিদু্যৎ আমদানির পরিকল্পনার বাংলাদেশের ঘোষণা একটি মাইলফলক দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন।
শক্তির চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায়, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা শুধু স্বতন্ত্র জাতির শক্তির চাহিদা পূরণ করে না বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, নেপাল-বাংলাদেশ বিদু্যৎ শুল্ক চুক্তি উন্নত অর্থনৈতিক সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। উভয় দেশের উচিত তাদের সম্পর্ক আরও জোরদার করার এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে, শক্তি সেক্টরের বাইরেও বৃহত্তর সহযোগিতার পথ অন্বেষণ করা। বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি, পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে যৌথ উদ্যোগ একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্বের ভিত্তি মজবুত করতে পারে- যা নেপাল ও বাংলাদেশ উভয়ের জনগণকে উপকৃত করবে। দুই দেশ এই ভাগ করা যাত্রা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে, নেপাল এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি মডেল তৈরি করার সম্ভাবনা রয়েছে- যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যরা অনুকরণ করতে পারে।
২০২২ সালের এপ্রিলে, নেপাল ও ভারত নীতিগতভাবে নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার ভারত সফরের সময় বিদু্যৎ খাতে সহযোগিতা সংক্রান্ত যৌথ বিবৃতি জারি করে শক্তি সহযোগিতার অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছে। এই বিবৃতিটি শুধু নেপাল-ভারত নয়, বাংলাদেশের সঙ্গেও শক্তির সহযোগিতাকে রূপ দিয়েছে। জ্বালানি বাণিজ্য করতে হলে নেপাল ও বাংলাদেশকে অবশ্যই ভারতকে বোঝাতে হবে- কারণ, ভারত ছাড়া জ্বালানি বাণিজ্য সম্ভব হবে না। নেপাল ও বাংলাদেশ উভয় পক্ষই বারবার ভারতকে তার ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চালনের সম্মতির জন্য অনুরোধ করেছে।
এপ্রিল ২০১৭ সালে তার ভারত সফরের সময়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নেপালের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত বিদু্যৎ খাতে সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। শুধু তার সফরেই নয়, তৎকালীন নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা এবং প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহালও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ২০২২ এবং ২০২২ সালে নয়াদিলিস্নতে তাদের সরকারি সফরের সময় আন্তঃসীমান্ত বিদু্যৎ খাতের সহযোগিতা সহজতর করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত ঘনশ্যাম ভান্ডারী দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি চুক্তি বাস্তবায়নে ঢাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। উভয় পক্ষের উচ্চ পর্যায়ের অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার ফল হলো- ভারত নেপালকে বিদ্যমান ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। এটা দুই দেশের জ্বালানি বাণিজ্যের শুরু মাত্র। আমরা আরও চেষ্টা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ভবিষ্যতে এটি আরও প্রসারিত করতে পারি।
জানুয়ারিতে কাঠমুন্ডুতে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সালাহউদ্দিন নোমান চৌধুরী বলেছিলেন যে, তার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদু্যতের চাহিদা মেটাতে নেপাল ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমানে ৩০,০০০ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৫,০০০ মেগাওয়াট। 'যদি নেপাল এখনই আমাদের ৩,০০০-৪,০০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করে, আমরা পুরোটাই ব্যবহর করতে পারব।'
ইতোমধ্যে, উপ-আঞ্চলিক সংস্থা বিবিআইএন-এ জ্বালানি বাণিজ্যের ধারণা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এই ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির আওতায় কিছু বাংলাদেশি নেপালের জলবিদু্যৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে, এটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ভুটান এই উপ-আঞ্চলিক ফরম্যাটে কাজ করতে আগ্রহী ছিল না। তাই, নেপাল ও বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে জ্বালানি চুক্তি করার জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় উপায় খোঁজার চেষ্টা করা উচিত।
২০২৩ সালের মে মাসে নেপাল, বাংলাদেশ এবং ভারত একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়। জ্বালানি সচিব পর্যায়ের যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে নেপালের এনইএ, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এবং ভারতের এনভিভিএন-এর মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এর আগে বাংলাদেশ প্রস্তাবের জন্য একটি খসড়া অনুরোধ (আরএফপি) পাঠিয়েছিল- যার জবাবে নেপাল শুল্ক নির্ধারণের প্রশ্ন তুলেছিল। দুই দেশই এখন কাজ করছে।
নেপাল থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে জ্বালানি পাঠানোর জন্য নেপাল ও বাংলাদেশের দীর্ঘ ও একটানা কাজ দুই দেশের মধ্যে সক্রিয় বিদু্যৎ কূটনীতির ইঙ্গিত দেয়। আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক উভয়ের পারস্পরিক সুবিধার জন্য এটি আরও শক্তিশালী করতে হবে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়