আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ১৯৭১ সালের নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস যেমন গৌরবের, তেমনি বেদনারও। অনেক রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। আজকের এই মহান দিনে স্বাধীনতাযুদ্ধের সব শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যারা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমরা শ্রদ্ধা জানাই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সব সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাকে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কীভাবে রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। যে সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল ২৫ মার্চের মধ্যরাত্রি তথা ২৬ মার্চ। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের বজ্রকঠিন সংগ্রাম ও হিরণ্ময় বিজয়ের কথা। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখন্ডের সমন্বয়ে নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের বলদর্পী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তস্নাত সংগ্রাম শুরুর মধ্য দিয়ে শত শত বছরের আকাঙ্ক্ষা পূরণে অগ্রসর হয়েছিল এই ভূখন্ডের বঞ্চিত ও শোষিত গণমানুষ।
একাত্তরে রেসকোর্স ময়দানের ৭ মার্চের বিশাল ঐতিহাসিক জনসভায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। আর এই দিন থেকেই আপামর বাঙালি পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়নের জটাজাল থেকে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারের প্রত্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। বেদনাবিধুর হওয়া সত্ত্বেও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং অর্জিত সাফল্য বাঙালির জীবনে হীরকোজ্জ্বল অধ্যায়। বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের ধারাবাহিক সংগ্রামের পূর্ণতা আসে লাখ লাখ শহীদের রক্ত এবং বহু ত্যাগের বিনিময়ে।
বলা দরকার, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। বিপুলভাবে অর্থনীতির সম্ভাবনা বাড়ায় দেশটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে মধ্যম আয়ের দেশের পথে অগ্রসর হচ্ছে। দেশের কৃষি, শিক্ষা, অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে। উন্নয়নের মহাসড়কে আজ বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে তারুণ্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ চেতনা অব্যাহত থাকলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ অর্জনের একটি। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে এভাবেই প্রকৃত ও কার্যকর ভিত রচিত হোক এটাই কাম্য।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা হোঁচট খেয়েছে বারবার। বজায় থাকেনি এর ধারাবাহিকতা। রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতাও এর বড় কারণ। এ ছাড়া উলেস্নখ্য, একাত্তরে শুধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নয়, এ দেশের কিছু কুলাঙ্গার পাকিস্তানিদের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছিল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশেও তারা বুক ফুলিয়ে চলেছে, গাড়িতে উড়িয়েছে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা লাল-সবুজ পতাকা। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, সরকার একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করে রায়ও কার্যকর করেছে। এ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত। আমরা মনে করি, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারপ্রক্রিয়া দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারাতেই কেবল ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি; এর মধ্য দিয়ে এটাও প্রমাণ হয়েছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনির্বাণ।
আজকের এই মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতির পিতা এবং তার সহকর্মী স্বাধীনতা যুদ্ধে সফল নেতৃত্ব প্রদানকারী জাতীয় নেতাদের কৃতজ্ঞতার সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সব শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাকে। একাত্তরে যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে কৃষকের সন্তান অস্ত্র ধারণ করেছিলেন, শ্রমিক কারখানার হাতুড়ি ছেড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙ্কারে অমিত বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ছাত্রছাত্রীরা ছেড়েছিলেন ক্যাম্পাস, নারীসমাজ সামলে ছিলেন ঘর ও বাইরের চ্যালেঞ্জ এবং বুদ্ধিজীবীরা অসির বিরুদ্ধে মসিকেই সংগ্রামের হাতিয়ার বানিয়েছিলেন- প্রতি বছর এই স্বাধীনতা দিবসের মধ্য দিয়ে একাত্তরের সেই সংগ্রামী চেতনা বর্তমান প্রজন্মকে আরও শানিত করবে।