১৯৪৭ সালের পূর্বতন ব্রিটিশশাসিত ব্রিটিশ ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র অজিত হলেও অর্থনৈতিক মুক্তিসহ প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণের যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী জনগণ তিলে তিলে জর্জরিত হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণ-অভু্যথান, সর্বশেষ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করল। ইতিহাসের পিছনে যেমন ইতিহাস থাকে তেমনি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে ১৯৬৯ সালের গণ-অভু্যথান, তার পিছনে ১৯৬৬-এর ছয়দফা আন্দোলন, তার পিছনে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিস্ফোরণপর্ব, তার পিছনে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম সফল বিস্ফোরণপর্ব, তার পিছনে ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত ও সূচনা পর্ব। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত ভাষা আন্দোলনের ও একুশের চেতনার স্বর্ণফসল। বস্তুত ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এগিয়ে যায়। ১৯৫৮ যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও গণ-অভু্যথান এবং ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুুুুশ বিজয় লাভ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘটনা। এ পথ ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটে।
স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে সংগ্রাম করেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতদঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সর্বস্তরের জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে অধিকার, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম করেছেন। ইতিহাসে ঈশা খাঁ থেকে ক্ষুদিরাম, বাঘা যতিন, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সময়ের ছকবদ্ধ গাঁথুনিতে সারিবদ্ধ হয় ইতিহাস। ইতিহাস মানব সভ্যতার অমূল্য দলিল। কোনো নির্দিষ্ট জাতি কিংবা গোষ্ঠী ইতিহাসের শিকড় ধরেই কেবল পৌঁছায় তার সমৃদ্ধ ও গৌরবময় অতীতের স্বপ্নঐতিহ্য ভান্ডারের সুবর্ণ দুয়ারে, যা থেকে মন্থন করে নেয় সে ভবিষ্যৎ চলার পাথেয়। ইতিহাস একমাত্র তখনই মূল্যবান, যখন তার ভেতর থেকে ভবিষ্যতের উন্নতির রসদ খুঁজে পাওয়া যায়। যিনি ইতিহাসের গতিধারা বদলে দেন তিনি নেতা। নেতা সৃষ্টি করে ইতিহাস। ইতিহাস সৃষ্টি করে মানুষ। আর এজন্যই ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত হয়ে থাকে এক সাগর রক্তের কাহিনী। মানবসভ্যতার অমূল্য দলিল হিসেবেই স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাই বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। স্বাধীনতা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা। বাংলাদেশের অভু্যদয় তাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। উলেস্নখ্য, আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধের ডিসকোর্সটা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত।
স্বাধীনতার মহান স্থাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের যোগফল রূপান্তরিত হয় মুক্তিযুদ্ধরূপে। মহান মুক্তিযুদ্ধের যে গর্বিত ইতিহাস আমাদের রয়েছে সেটা বিশ্বের কম জাতিরই রয়েছে। নতুন প্রজন্মকে এই গর্বিত ইতিহাস জানাতে এবং সংরক্ষণ করতে হবে।
\হইতিহাসের ধারাবাহিকতা ১৯৭১ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় বছর। স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। স্বাধীনতা আমাদের জন্য একটি স্বর্ণদুয়ার খুলে দিয়েছে যে, স্বর্ণদুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করার অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারি। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের প্রেরণা। মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
মুক্তিযোদ্ধাদের মহিমান্বিত ও দুঃসাহসিক বীরত্বের অমরগাঁথা কোটি কোটি বাঙালি হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরজাগরূক থাকবে। বাঙালির যা কিছু বড় মাপের অর্জন, তা সম্ভব হয়েছে বাঙালির ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিতে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সুস্পষ্ট নির্দেশনামূলক ঘোষণার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ ৭ই মার্চ, যেটা জাতির প্রেরণার উৎস। যার ফলশ্রম্নতিতে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস স্মরণীয়, বরণীয়, চিরস্মরণীয়, অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ২৬ মার্চকে তাই এ জাতি স্মরণ করে আত্মশক্তির প্রতীক হিসেবে। স্মরণ করে আত্মমর্যাদার দিকদর্শনরূপে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনার মাস এই অগ্নিঝরা মার্চ। ২৬ মার্চে যার সূচনা, ১৬ ডিসেম্বরে তার পরিপূর্ণতা। ২৬ মার্চ যেহেতু এর সূচনা, তাই এই দিনটা আমাদের রক্তসিক্ত স্বাধীনতা দিবস।
প্রফেসর মো. আবু নসর : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ