মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস। ২৬ মার্চ থেকে আমাদের স্বাধীনতার পথ খুলে যায়, আমরা এগুতে থাকি চূড়ান্ত বিজয়ের পথে। বাঙালির জাতীয় জীবনে এই দিনটির তাৎপর্য অপরিসীম। তাই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস।
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনঃগঠনের দায়িত্ব নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলছিল দেশ। কিন্তু সে পথচলা উন্নয়ন থমকে দাঁড়ায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ অনেক বছরের জন্য পিছিয়ে পড়ে।? বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এলেও দেশের উন্নয়ন তেমনটা পরিলক্ষিত হয়নি। এরপর বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতার আসার পর দেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান হতে শুরু করে। ২০২১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রমের পরও আমরা অনেক? ক্ষেত্রে মুক্ত হতে পারিনি।
দারিদ্র্য বিমোচন ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো পূর্ণাঙ্গরূপে ঘটেনি। দেশ স্বাধীনের এত বছর পরও দেশের স্বাধীনতা নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশে এখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প বিদ্যমান। শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়াবহ সংকট। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে নেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর অপরাজনীতিতে মুখরিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ। অথচ বলা হয়ে থাকে, 'শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।' দেশের উচ্চশিক্ষার সবোর্চ্চ প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পরিস্থিতি ভয়াবহ। লবিং আর টাকার বিনিময়ে নিয়োগ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। ৮ লাখ কিংবা ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়! আর উপাচার্যও নাকি অনেক টাকা খরচ করে গদি কিনেন! দেশের উচ্চশিক্ষার সবোর্চ্চ প্রতিষ্ঠান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল কেমন, সে প্রশ্ন না ওঠে পারে না। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নেই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক অবস্থান। দেশের বিশাল তরুণপ্রজন্ম গবেষণা, সৃজনশীল কাজ ছেড়ে শুধু বিসিএস দিয়ে আমলা হওয়ার পেছনে দৌড়াচ্ছে শুধু করুণ শিক্ষাব্যবস্থার নিয়মের কারণে। অথচ তরুণপ্রজন্ম একটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। এ সুবিশাল সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ নিয়ে যেন ভাবার কেউ নেই! অথচ আমরা যদি আমাদের বিশাল সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে যথাযত পরিচর্যা করতে পারতাম, তাহলে আমাদের দেশ বহু আগে? উন্নতির সোপানে পৌঁছত।
দেশের স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা কতটা ভঙ্গুর তা করোনা সংক্রমণ শুরুর দিকে আমাদের সবার সামনেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে ২০২০ সালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল মহামারি করোনাভাইরাস। ২০২১, ২০২২, ২০২৩? পেরিয়ে ২০২৪ সালেও এ ভাইরাস আলোচিত বিষয় এবং ভাইরাসের শক্তি এখনো বেগবান। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাত কতটা দুর্বল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। জনসম্মুখে ওঠে এসেছে সব অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতার চিত্র। ওঠে এসেছে স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের অমানবিক কর্মকান্ড। প্রকাশ্যে উন্মুক্ত হয়েছে কতটা অদক্ষ জনবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যখাত। প্রকৃত অর্থে একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা কাজে আসে না। কেননা জনগণই একটি দেশের শক্তি। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। দেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে আস্তে আস্তে চোখে পড়তে শুরু করে দেশের স্বাস্থ্যখাতের বেহাল অবস্থা। করোনা না আসলে হয়তো দেখা যেত না দেশের স্বাস্থ্যখাতের এমন দুর্বলতা, অপব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির হালচাল তথা স্বাস্থ্যখাতের সার্বিক করুণ চিত্র। সাবরিনা-শাহেদদের ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট বাণিজ্য, কোভিড সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা, চিকিৎসার অবহেলায় রোগীর মৃতু্য, ড্রাইভার মালেকের দুর্নীতিকান্ড, করোনার প্রণোদনায় লুটতরাজ ইত্যাদি কর্মকান্ড জনসম্মুখে প্রকাশ পেতে শুরু করে।
করোনাকালীন সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় আমরা প্রযুক্তিতে কতটা পিছিয়ে আছি। করোনাকালীন সময়ে বিশ্বের অন্য দেশের জনগণ যখন ঘরে বসে অনলাইনে তাদের সব কাজ করতে সক্ষম হচ্ছে আমরা কিন্তু তেমনটা পারছি না। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের প্রযুক্তির দুর্বলতা। এখনো পর্যন্ত কিন্তু আমাদের দেশের সব জায়গায় আনাচে-কানাচে পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া যায় না। তাছাড়া জনগণের প্রযুক্তি সম্পর্কে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের যথেষ্ট জ্ঞান না থাকা আমাদের প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক/শিক্ষিকাই কিন্তু এ ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করা একটা দেশের জন্য তা লজ্জাকর ব্যাপার।
দেশে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বারবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আজকে চালের দাম বৃদ্ধি, কালকে পেঁয়াজ-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে বাজারে কারসাজি সৃষ্টি করে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে সিন্ডিকেট চক্র। অথচ এদের নির্মূলে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণের নাভিশ্বাস এখন চরমে।? বর্তমানে জনরোষ দূরীকরণে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক থেকে জনসাধারণের সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। কেন কিছুদিন পর পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, এর নেপথ্যে কারণ উদ্ঘাটন করে সার্বিক বাজারব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
চারদিকে শুধু দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাটের দৃশ্য। আর এগুলোই আমাদের উন্নয়নের পথে বড় বাধা। দেশের অর্থসম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। রক্ত দিয়ে কেনা সম্ভাবনাময় একটি দেশ কতিপয়ের হাতে এভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না। এদের লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমাদের অর্জনের মতো বলার অনেক কিছুই আছে।? পুরো বিশ্ব যখন বলেছিল আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হব না, আমরা তা করে দেখিয়েছি। আমাদের মেট্রোরেল হয়েছে, বঙ্গবন্ধু টানেল হয়েছে,? শতভাগ বিদু্যতায়ন হয়েছে, গৃহহীনরা ঘর পেয়েছে, নগর উন্নয়ন প্রকল্প আছে বহু। কিন্তু এসবের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, জনগণের জীবনমান, নাগরিক সুবিধা-অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আর এজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি, সব বাধা সংকট অতিক্রম করে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে রোল মডেল হয়ে উঠবে, এটাই প্রত্যাশা।
ইমরান ইমন : গবেষক ও কলামিস্ট