মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

থামছে না অগ্নিকান্ড মীর আব্দুল আলীম

অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা থাকলেও তা মানছেন না সিংহভাগ ভবন মালিক। নগরীতে বেশিরভাগ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। অগ্নিনির্বাপণ আইনের তোয়াক্কা না করে নগরীতে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শত শত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন।
  ২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
থামছে না অগ্নিকান্ড মীর আব্দুল আলীম

আগুন নিভে গেছে, লাশের দাফন-কাফনও হয়েছে। জনউত্তাপ আর প্রশাসনের হম্বিতম্বিও ফুরিয়েছে। অভিযান প্রায় শেষ। এখন সব ভুলে যাওয়ার পালা। আমরা রাজধানীর বেইল রোড়ের অগ্নিকান্ডের ঘটনার কথা বলছি। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চ'াপিয়ে ইতোমধ্যে দায় শেষ করতে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। আমার প্রশ্ন আছে অনেক- ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করছি। যিনি ট্রেড লাইসেন্স দিলেন তার কিন্তু লাইসেন্স দেওয়ার আগে সব ঠিকঠাক আছে কিনা যাচাই বাছাই করবার কথা। সেটা বোধ করি করা হয়নি। রাজউকের যাচাই বাছাই তদারকি কি হয়েছিল? হলে ভবনটি অনিরাপদ ছিল কেন? অনিরাপদ ওই ভবন ফায়ার সাভিসের লাইসেন্স পেল কি করে? নিরাপদ সিঁড়ি নেই। একটি ভবনে এতগুলো হোটেল রেস্তোরাঁ, ছিল না অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। কি করেছে সংশ্লিষ্টরা? এটা তো তাদেরই দেখার কথা ছিল। কেউ তাদের স্ব স্ব জায়গা থেকে কাজ করেনি। পয়সা পেয়ে অফিসে বসেই সব কাগজ ঝকঝকা করে দিয়েছে মালিকপক্ষকে। বেইলি রোড়ের আগুনে ৪৬ জন মানুষ মারা গেল এর দায় কার ছিল? উপরোলিস্নখিত সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো অবশ্যই দায়ী। এদের কারো বিরুদ্ধে কি মামলা হয়েছে? কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন? একজনও না। গোবেচারা ম্যানেজার আর কর্মচারীকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে হাজতে পাঠানো হয়েছে। এ দেশে এভাবে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে আর কত চাপানো হবে? আবারও হয়তো অপেক্ষা করছে এর চেয়েও বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের কঠিন সাজা আওতায় আনা হলে এ জাতীয় অগ্নিকান্ডের দুর্ঘটনা কমে আসত।

ঢাকার অনিরাপদ অবৈধ ভবনগুলো টিকে আছে কি করে? রাজধানীর অধিকাংশ ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। এটা কি করে সম্ভব? বিল্ডিং কোর্ড আর নকশা না মেনেই হচ্ছে ভবন তাহলে আগুন লাগলে কিংবা ভূমিকম্প হলে মানুষ তো মরবেই। আমাদের বড় একটা ব্যামো আছে। কোনো কিছু ঘটে গেলে হৈ চৈ করি। আফসোস করি। কতদিন এটা নিয়ে হম্বিতম্বি হয়। তারপর শেষ। ভুলে যাই সব। রাজধানীর বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ থেকে আগুন লেগেছে আমরা ছুটছি সেই রেস্তোরাঁ নিয়েই। প্রশাসন নড়ে চড়ে বসেছে। অবৈধ রেস্তোরাঁ ভাঙার কাজ চলছে রাজধানী জুড়ে। রাষ্ট্রের যারা এসব দেখার দায়িত্বে ছিলেন তারা এতদিন এসব দেখেননি, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। আর এখন সব দায় পড়ছে ভবন মালিক আর রেস্তোরাঁর মালিকদের ঘাড়ে। আইনের প্রয়োগ থাকলে আর আইন মানতে বাধ্য করা হলে এসব অনিয়ম থাকত না, মানুষও এভাবে লাশ হতো না।

জাতীয় একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, পুরনো ঢাকার পর রাজধানীর বনশ্রীতে আগুনের ঝুঁকি সবচাইতে বেশি। সংবাদে উলেস্নখ করা হয়েছে, বনশ্রী ডি বস্নকের ৮ নাম্বার রোডের রেডিয়েন্ট কৃষ্ণচূড়ায় কন্ডেমিনিয়ামে রয়েছে তিনটি ১০তলা ভবন। এসব ভবনে ৯০টি পরিবারের প্রায় সাড়ে ৮শ' মানুষ বসবাস করেন। এই ভবনের মূল ফটকে বিশাল ক্যামিকেল গোডাউন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করেও তারা কোনো সরাহা পায়নি এ ভবনে বসবাসকারীরা। বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ ভবনটি প্রতিষ্ঠার পর ফায়ার সার্ভিসের কোনো ব্যক্তি এখানে অসেননি। এই হচ্ছে আমাদের আবাসিক ভবনগুলোর অবস্থা। নূ্যনতম নিরাপত্তা নেই কোথাও। এমন ভবনগুলোতে আগুন লাগলে কি হবে? শত শত মানুষ লাশ হবে আর আমরা আহ্‌ উহ্‌ করব। এতটুকুই!

সরকার যদি রাজধানীবাসীকে নিরাপদ করতে চায়, ফায়ার সার্ভিসকে গতিশীল করতে হবে। আগুন লাগলে ছুটে যাবে এমনটা যেন না হয়। প্রতিটি ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা আছে কিনা তা যেন তলস্নাশি করা হয়। প্রতিটা ভবনে কিংবা কয়েকটা ভবন মিলে যেন বাসিন্দাদের আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক কি করতে হবে তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের (অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাতীয় একটি দৈনিকে বলেন, 'আমরা ভবনের মালিককে নোটিশ দিতে পারি। এ ছাড়া আর কিছু করার নেই। আমাদের আইনের মধ্যে যা যা করা সম্ভব, তা-ই করছি।' লেখাটা পড়ে হতভম্ব হয়েছি। এমন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কি করে এমন বক্তব্য দিতে পারেন। কেউ আইন না মানলে তাকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন যে, নোটিশ দেওয়ার পরেও কাজ না হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ভবনগুলোর একটির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে বাকিগুলো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে এজন্য ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই ঠিকঠাক জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও। সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা অনুসরণ না করে তৈরি হওয়া ভবনগুলো পরিণত হয়েছে মৃতু্যফাঁদে! ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে ভবন মালিকদের নোটিশ দিলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না ভবন মালিকরা। এমনকি নোটিশের জবাবও দেন না। ভবন নির্মাণ ও সম্প্র্রসারণে নিয়ম না মানা এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা না মানার ফলে বারবার মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অগ্নিকান্ডের ফলে প্রাণহানি, আহত হওয়ার ঘটনা ও সম্পদের ক্ষতি বেড়েই চলেছে। বছরে কয়েকশ' মানুষের প্রাণ যাচ্ছে অগ্নিকান্ডে। অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আগুন লাগলে মানুষ যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশস্ত সিঁড়ি এবং এক ভবন থেকে আরেক ভবনের প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করা জরুরি।

অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা থাকলেও তা মানছেন না সিংহভাগ ভবন মালিক। নগরীতে বেশিরভাগ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। অগ্নিনির্বাপণ আইনের তোয়াক্কা না করে নগরীতে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শত শত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন।

\হঅগ্নিনির্বাপণ আইনে পরিষ্কার বলা আছে, ছয়তলার ওপরে ভবনের ক্ষেত্রে তিন স্তরের নিজস্ব স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রথম তলা থেকে তিন স্তরের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার বিধান রয়েছে। বেশিরভাগ আবাসিক ভবনেই তিন স্তরের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দূরে থাক, অনেক এলাকার সড়ক এত সরু, কোনো ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশেরও সুযোগ নেই। ফলে প্রতি বছর অগ্নিকান্ডে প্রচুর পরিমাণ সম্পদহানি হচ্ছে। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারা ও অর্থদন্ডসহ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তির বিধানও রয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেও এ আইন প্রয়োগের নিয়ম আছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে এসব আইনের প্রয়োগ নেই।

নামমাত্র অনুমোদন নিয়ে বা না নিয়েই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অনিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কারণে নিয়ম না মানা ভবন মালিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে একদিকে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে অগ্নিকান্ডের পর নির্বাপণ ব্যবস্থা ও ভবন থেকে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা আরও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এসব অসঙ্গতি দূর করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

হবংিংঃড়ৎবসরৎ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে