আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস হিসেবে পরিচিত মাহে রমজান। তবে এই সংযম থাকা দরকার বাজারেও। রমজান আসলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে কারসাজির প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এ বছর এমনিতেই রমজানের কয়েক মাস আগ থেকেই নিত্যপণ্যের চড়া দাম, এর ওপর আবার রমজানকে ঘিরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার আগুন। অথচ প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের অধিকাংশ আমাদের এই দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, 'বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে। আর মাত্র ১ কোটি ২৫ লাখ টন দ্রব্য আমদানি হয়।' তবুও আমদানির দোহাই দিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যের দামে লাগামহীনতা। এতে অশ্রম্নসিক্ত সাধারণ মানুষের চোখ। বিশেষ করে 'যারা দিন আনে দিন খায়, নুন আনতে পানতা ফুরায়' এমন অসহায়, দরিদ্র মানুষের জন্য বেশি কষ্টকর। এদের কষ্ট কি কখনো লাঘব হবে না?
অথচ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো রমজান মাস আসলেই খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম কমিয়ে সাধারণ জনগণের দরজায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্যেগ নিয়ে থাকে। যেমন, এ বছর রমজান উপলক্ষে কাতারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় ৯০০টির বেশি ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যেগ নেয় এবং গত ৪ মার্চ থেকে কার্যকর করেছে নতুন মূল্য তালিকার। যা রমজানের শেষ দিন পর্যন্ত চলবে। উলেস্নখ্য, মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি ২০২১ সালে ৬৫০, ২০২২ সালে ৮০০ এবং ২০২৩ সালেও ৯০০ এর বেশি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম কমিয়েছিল। এ ছাড়া আরব আমিরাতেও কমানো হয়েছে প্রায় ১০ হাজার পণ্যের দাম। এর ৮০ শতাংশই অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য। ভোজ্যতেল এবং ময়দার মতো নিত্যপণ্যের দাম কমানো হয়েছে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। শুধু মুসলিম দেশগুলোই নয়, এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশেও মুসলিম অধু্যষিত এলাকায় রমজান উপলক্ষে দেওয়া হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর বিশেষ মূল্যছাড়।
মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বিশেষ ছাড় থাকলেও, ৯০/৯৫ শতাংশ মুসলিমের এই বাংলাদেশে চোখে পড়ে এর উল্টো চিত্র। রমজানে বিদেশে মূল্য হ্রাস হলেও নিজ দেশের ভোক্তাদের উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে ফেলতে হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। বাংলাদেশের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রমজান মাস আসলেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, কে কত বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করবে?
সরকারি বিপণনকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২১ সালে রোজার সময় সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, খেজুরের দাম ১০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে দেখা যায়। ২০২২ সালে রোজায় সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১০ টাকা বেড়ে ১৬০-১৬৫ টাকায়, পেঁয়াজ ২৫-৩৫ টাকায়, চিনি ৭৫-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২০২৩ সালেও রোজায় দাম বৃদ্ধির এই চিত্র পরিবর্তিত ছিল না। এ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে আরও বেশি। দ্রবমূল্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি মানুষের জীবনযাত্রার মান, বাড়েনি বেতন-ভাতা বা পারিশ্রমিক। এ অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। মনে রাখা উচিত, মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে না, বাঁচার জন্যই খায়।
কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি পুরো দেশের মানুষ। এই অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের অতিরিক্ত লাভের জন্য বিপাকে ফেলছে দেশের বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এবং হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ আলস্নাহ পাক বলেন, 'তোমরা একে অপরের ধনসম্পদ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করো না। পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন বা লাভ করো।' (সুরা আন নিসা, আয়াত ২৯) তাদের এই লোভের কারণে কত শত গরিব মানুষের ইফতারে শুধু পানি, আর সেহরিতে ভর্তা-ভাত ছাড়া ভাগ্যে জুটেনি ভালো কোনো খাবার। যদিও সরকার নিত্যপণ্যের মূল্য হ্রাসে কাজ করে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বা নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত খুঁজছেন প্রতিকার। তবুও সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করে যে, কে বা কারা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, তা দায়িত্বশীল বা প্রশাসন মহলের অজানা নয়। তারা চাইলেই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির রোধ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অতঃএব সাধারণ জনগণের কষ্ট নিরসনে দেশের দায়িত্বশীলদের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি কৃষকপর্যায় থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত পণ্যের দামে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করত, তাহলে বছরজুড়েই ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ বা জনসাধারণের সামর্থ্যের নাগালের মধ্যে থাকত। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ ও নজরদারি বাড়ানো সময়ের দাবি।
মোফাজ্জল হোসেন
শিক্ষার্থী ও তরুণ লেখক