কোনোভাবেই থামছে না ছাত্রী নিপীড়ন। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন ছাত্রী নিপীড়ন কেন্দ্র। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নির্যাতন, নিপীড়নে কলুষিত হচ্ছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা নিপীড়নের শিকার হয়ে কদিন আগে আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া সম্প্রতি ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, ইসলামী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। অবাক ব্যাপার যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাময়িক বহিষ্কার ছাড়া কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বড় অপরাধে ছোট মাত্রার শাস্তি হওয়ার কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিনে দিনে ছাত্রী নিপীড়নে কলুষিত হয়ে উঠছে। এটা দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক বিপজ্জনক বার্তা।
অপ্রিয় হলেও সত্য, ছাত্রী নিপীড়নে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগও করতে সাহস পান না ভুক্তভোগীরা। দু'একটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও অভিযোগ রয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার না পাওয়ার। বিচার না পেয়ে দিনের পর দিন ট্রমার শিকার হন ছাত্রীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি গড়ায় আত্মহত্যা পর্যন্ত। যেমনটি ঘটেছে অবন্তিকার ক্ষেত্রে। শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা সবখানেই ছাত্রী নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। নিপীড়করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি বন্ধ করতে হলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই এগুলো বন্ধ করতে পারে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। নিজের ফেসবুক পাতায় সুইসাইড নোট পোস্ট করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষার্থী কুমিলস্নায় তার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করার বিষয়টি সহজভাবে দেখার উপায় নেই। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এবং একজন সহকারী প্রক্টরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, কয়েকজন সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের মানসিক উৎপীড়নের কারণেই অবন্তিকা আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছে। এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার পেছনের কারণ যাই থাকুক না কেন, প্রবণতাটা হচ্ছে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। যেন একজনের দেখাদেখি অন্যজন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে অথবা তাকে আত্মহত্যার পথে চলে যেতে বাধ্য করানো হচ্ছে।
একুশ শতকে এসে যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার মহাজাগরণ ঘটবে, সেখানে অর্থকে কেন্দ্র করে নারী ভাগ্যবিড়ম্বিত হচ্ছে- তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও নারীর অবমাননা, নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। ইদানীং নারীদের মধ্যে একটা ভয়ানক প্রবণতা কাজ করছে, আত্মহননের মাধ্যমে জীবনের মুক্তি। নিজের জীবন অকালে বিসর্জন দিয়ে পৃথিবী থেকে মুক্তির যে কোনো মানে হয় না- এ সহজ কথাটা আত্মহত্যাপ্রবণ নারীকে কে বোঝাবে।
কেবল যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে গত দুই দশকে বহু নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। বর্তমান সমাজে নারীরা নানামুখী নির্যাতনের শিকার। নারীদের উচিত এ নির্যাতনের প্রতিবাদ করা, এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নির্যাতনের নিষ্ঠুর শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া নয়।
ইভ টিজিংয়ের যারা প্রতিবাদ করছে তারাও অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা যারা বখাটে সন্ত্রাসীদের পিতা, তারা সন্তানকে সুপথ-ন্যায়ের পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। আর আমাদের ব্যর্থতা অবলীলায় চাপিয়ে দিচ্ছি রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর। হয়ত বা রাষ্ট্র বা সরকার ব্যর্থ কিন্তু নিজেদের ব্যর্থতার কথা আগে স্বীকার করতে হবে। আমার সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে- এ বিষয়টি দেখার ও তদারকির দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে আমারই, অন্যের নয়। টমাস ফুলার বলেছেন, ভালো লোকের সাহচর্যে থাক, তোমার বুদ্ধি না থাকলেও তারা সময়মতো ভালো পরামর্শ দেবে। একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, সৎ ও ভালো মানুষ কখনো বিপজ্জনক হয় না।
একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রয়েছে বলে উচ্চ কণ্ঠে বলা হচ্ছে- যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার নারী- বেশ কজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নারী রয়েছে বর্তমান সরকারে। সেখানে নারীরা অরক্ষিত বা নিরাপত্তাহীন থাকে কী করে।
নারী ছলনাময়ী, দ্বি কিংবা বহুচারিণী। নারী কুলটা এসব অপবাদ দিয়ে তাকে ঘর-সংসার থেকে বের করে দেয়া, নারীকে নানাভাবে কলঙ্কিত ও অমর্যাদা করা কোনো সভ্য সমাজের কাজ নয়। চারদিকে যেভাবে নারী জাগরণ ঘটেছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী নারীর ক্ষমতা সুসংহত হচ্ছে, সেখানে আমাদের নারীরা কেন এতটা অসহায়ত্ব ও অবমাননার শিকার হয়ে বৃত্তবন্দি হয়ে জীবনযাপন করবে।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল অভাব-দারিদ্র্য। তারা বউ ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো ভরণ-পোষণ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করত। স্ত্রী-সন্তানদের বিপদে ফেলে, তাদের ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে এভাবে আত্মহত্যা করা কাপুরুষতা। তা সত্ত্বেও ওই আত্মহত্যার মধ্যে পারিবারিক ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠলেও নিষ্ঠুরতা, শোষণ, নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠত না। উপরন্তু, স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তাদের ভরণপোষণে নিজের অসহায়ত্ব ও অক্ষমতার চিত্রই উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আর আজ স্বামীর মধ্যে ফুটে উঠছে নিষ্ঠুরতা ও লোভ। সব ধরনের লোভ, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা পরিহার করে স্বামীকে দায়িত্ব নিতে হবে তার স্ত্রীকে রক্ষার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকেও একই দায়িত্ব নিতে হবে। যাতে অবন্তিকারা অকালে ঝরে না যায়।
অভিমানী, নির্যাতিতা, বঞ্চিত-শোষিত, অবমূল্যায়ন নিপীড়নের নিষ্ঠুর শিকার নারীরা এই সমাজ সংসারে আর বেঁচে থাকতে চায় না। তারা একাই যে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাই নয়- সঙ্গে মারছে আদরের সন্তানদেরও। যে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মা জীবন দিয়ে দেয়, সেই সন্তানের শরীরে কেরোসিন ঢেলে মা নিজেই পুড়িয়ে মারে। এমন নিষ্ঠুর পাশবিক ও মর্মান্তিক ঘটনা সমাজের বিবেকবান মানুষ কী করে সহজভাবে মেনে নেয়?
সংসার শুধু একজনের ত্যাগ, সংযমশীলতা ও ভালোবাসায় টিকে থাকে না। স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই চূড়ান্ত ধৈর্য, ত্যাগ ও সংযমের পরিচয় দিতে হয়। দুই মানুষ, দুই সত্তা, দুই রক্ত-মাংসের শরীর। পছন্দ-অপছন্দ রুচিবোধও ভিন্ন। ধৈর্য ও সহনশীলতার বাঁধ ভেঙে গেলে ওই বাঁধ মেরামতের দায়িত্ব স্বামী-স্ত্রীর, না হয় পরিবারের অভিভাবকদের। পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে গেলে এর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি অটুট রাখতে হবে সামাজিক বন্ধন। বজায় রাখতে হবে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ। ছাত্রীরা যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে, নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে, তা হলে আমরা কীভাবে বুঝবো সমাজ বদলেছে, বদলেছে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা। পুরুষতান্ত্রিক ছোবল কি থামবে না?
আমরা কিন্তু বিশৃঙ্খলা কিংবা বর্বর সমাজে বাস করছি না, যে ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতার কারণে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন কাচের টুকরার মতো ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। তাই কোনো পরিবারে সংকট দেখা দিলে ওই পরিবারের অভিভাবক বা আত্মীয়স্বজনকে দ্রম্নত হস্তক্ষেপ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বামী-স্ত্রীকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। ফ্রান্সের পরিবারগুলো এতটাই ভাঙনপ্রবণ যে, ৮০ ভাগ নারী বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে এবং তারা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। দুই জীবন এক ছাদে থাকা অসহনীয় হয়ে উঠলে পৃথক হয়ে যাওয়াই সমীচীন। কাউকে হত্যা করে কিংবা আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে প্রিয় সন্তানদের জীবন সংহার করার মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটানো কোনো সভ্য সমাজের স্বামী-স্ত্রীর কাজ নয়। একইভাবে কাজ নয় কোনো সহপাঠী শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের। আসুন, আমরা ত্যাগ, সংযম ও কর্তব্যবোধে বলীয়ান হয়ে অসভ্য, অমানুষ, বর্বর নয় আদর্শ মানুষ হিসেবে সভ্য হয়ে গড়ে উঠি। নারী বিষয়ে আমাদের মানসিকতার বদল ঘটাই।
সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক