১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করার সময় মুক্তিযোদ্ধা আর নিরীহ জনগণ কাউকে রেহায় দেয়নি পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। পাকিস্তানি হানাদাররা স্থানীয় দোসরদের নিয়ে চালায় নিরীহ মানুষের ওপর হত্যা, নারী ধর্ষণ, অত্যাচার ও লুটপাট। মেতে ওঠে ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করার মহোৎসবে। কখনো গ্রামে গ্রামে ঢুকে বা বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দু-মুসলমানদের ধরে এনে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। লাশের গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়েছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা মানুষ হত্যা করে চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসীরা সেই লাশগুলোকে একত্র করে মাটিচাপা দিয়েছিল সেদিন। রণাঙ্গনে যেভাবে প্রাণ হারিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়া নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে পাকবাহিনীরা। হত্যাকান্ডের পর কোথাও লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়, আবারো কোথাও উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে লাশের সারি। কোথাও কোথাও হত্যাকান্ডের পর স্থানীয় লোকজন লাশগুলোর সৎকার করেছেন।
স্বাধীনতা পরে সেই স্থান গুলির কিছু অংশ গণকবর হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও সঠিকভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অনেক গণকবর চিহ্নিতকরণ না করায় সেগুলো এখন মানুষের কাছে অজানা। এদিকে, স্বাধীনতার পর কিছু জায়গা চিহ্নিত হলেও এখন সেগুলো বেহাল দশা। সে রকমই অবহেলিত একটি গণকবর সিরাজগঞ্জের উলস্নাপাড়ার দহুকুলা গ্রামে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলেও গণকবরটি সংরক্ষণের নেই কোনো উদ্যোগ। গণকবর ও স্মৃতিস্তম্ভ এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। অযত্নে-অবহেলায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলছে ৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী দহুকুলা গ্রামের এই গণকবরটি।
দেশ মাতৃকার টানে পাক হানাদার রুখতে ১৯৭১ সালে চলা মুক্তিযুদ্ধের সময় সেদিন ছিল ২৫ অক্টোবর। তখন পাকহানাদার বাহিনী উলস্নাপাড়া উপজেলার দহকুলা গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদের মধ্যে লাহিড়ী পাড়া গ্রামের নিতাই ঠাকুর, প্রভাত ঠাকুর, রাস বিহারী কুন্ডু, শচিন কুন্ডু, ন্যাপাল কুন্ডু, বিভূতী কুন্ডু, গোপাল শীল, মংলা শীল, হিরু শীল, গনেশ শীল, নিতাই সাহা, বিমল বাগচী, হারান সরকার, চরমোহনপুর ঘোষপাড়া গ্রামের সূর্য ঘোষ, মনোরঞ্জন ঘোষ ও মোহনপুর বাজারের মানিক পাল এদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। একপর্যায়ে সবাইকে গুলি করে হত্যার পর লাশগুলো একত্রিতভাবে পুঁতে রাখা হয়। দীর্ঘদিন গণকবরটির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
পরে শহীদদের স্বজনরা কবরটির সন্ধান পেলে নিজেদের উদ্যোগে গণকবরটি কিছুটা সংরক্ষণ করেন। দেশের জন্য যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে স্বাধীনতা, লাল সবুজের পতাকা তাদের পরিবারের সহযোগিতায় নামফলক গড়ে তোলা হয়েছে। অবাক হলেও সত্য নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ। সরকারিভাবে গণকবরটি যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ না করায় এর নামফলকের পাশেই জায়গার মালিক গড়ে তুলেছে টয়লেট। দীর্ঘদিন পরে সেখানে শুধু একটা নামফলক স্থাপন করা হয়, যাতে করে শহীদের পরিবার আরাধনা/প্রার্থনা করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় গণকবরটি নামফলকের পাশেই গড়ে উঠেছে টয়লেট! যা জাতির জন্য লজ্জাকার ও শহীদ পরিবারে কাছে খুব কষ্টকর।
শুধু সিরাজগঞ্জের এই গণকবরটি নয়, এমন শত শত গণকবর রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অথচ স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও জানা যায়নি সঠিকভাবে দেশে কতগুলো গণকবর আছে। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছেও নেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য। তবে, একটি সংস্থা ৬৪ জেলার ৩২টি জেলায় জরিপ চালায়। ৩২ জেলার জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বধ্যভূমির সংখ্যা ৭২৫টি, গণহত্যা ১৩ হাজার ৬৫০টি, গণকবর আছে এক হাজার একটি এবং নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ৬২টি।
দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান মিলছে তাদের জরিপে। সময়ের বিবর্তনে বহু গণকবরের নাম-নিশানা মুছে ফেলে সেখানে দালান-কোঠা গড়ে তোলা হয়েছে। অযত্নে-অবহেলায় অনেক গণকবর লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে গেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদররা যুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তারা নির্যাতন ও হত্যার জন্য বিশেষ বিশেষ স্থানও বেছে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল তার প্রমাণ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান। নতুন প্রজন্মের যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে আগ্রহ হবেন। অঞ্চলের গণকবর, বধ্যভূমি যুদ্ধস্থানগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ব্যবহার হবে। তখন তাদের জন্য এসব গণকবর ও বধ্যভূমি, যুদ্ধস্থান দলিল হিসেবে কাজ করবে, এতে সন্দেহ নেই।
সর্বোপরি দেশের জন্য যারা সেদিন জীবন দিয়েছিল, তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সংরক্ষিত করা নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু আমরা কতটুকুই তা করছি? বাংলাদেশের এই ইতিহাস শুধু সরকারে পক্ষে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তারপরেও ক্ষমতাশীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বা ইতিহাস রক্ষায় আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু এটা সরকারে দায়িত্ব নয়। এটা সংরক্ষণের দায়িত্ব আপনার আমার সবার। তবে, সরকারে স্থানীয় প্রশাসন থেকে যদি সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসবে। বেশিরভাগ গণকবরগুলোর স্থান প্রায়ই ব্যক্তিমালিকানাধীন, সেই জায়গার অব্যশই তার অধিকার থাকে। যদি সরকার ন্যায্যমূল দিয়ে তাকে দেশের আত্মত্যাগের বিষয়বস্তু বুঝিয়ে বলে তাহলে অব্যশই জায়গার মালিক ছেড়ে দেবে স্থানটি। কারণ দেশের
মানুষ এই দেশকে ভালোবাসে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রয়েছে অনেক আবেগ ও ভালোবাসা। শুধু দরকার সবার সহানুভূতি। তাহলে এই সোনার বাংলাদেশ হাজার বছর পরেও দেশের মানুষ আত্মত্যাগের মহিমার কথা মনে করে শ্রদ্ধা ও সম্মান করবে শহীদদের।
ইমরান হোসাইন : কলাম লেখক