বিএনপির বিদেশ নির্ভরতা ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি রাজনৈতিক দলের উত্থানের পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থনের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প থাকে। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের ধ্বংসের জন্য হাতে গোণা দু'একটি কারণই যথেষ্ট। যখন একটি রাজনৈতিক দল একবার নয়, দুবার নয় বারংবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দল পরিচালনা করে তখন তার ধ্বংস অনিবার্য।
প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মো. সাখাওয়াত হোসেন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সরকার আন্তর্জাতিকভাবেও বেশ শক্ত অবস্থানের দিকে এগোচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। পারস্পরিক সম্পর্ককে জোরদার করবার নিমিত্তে কূটনীতিকরা নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে এবং বাংলাদেশ সরকারও সেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে থেকেই ভারত, চীন, রাশিয়া বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে রয়েছে এবং নির্বাচনকালীন উদ্ভূত পরিস্থিতি পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাতেও বাংলাদেশের সক্রিয়তা আরও বেশি করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
\হভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, শুরু থেকেই বিএনপি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করেছে। তথাপি দলটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সব ধরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নির্বাচনকে বন্ধ করতে পারেনি। দল হিসেবে বিএনপির অন্যতম প্রধান ব্যর্থতা হচ্ছে অতিমাত্রায় বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র একটা কিছু করে দেবে, ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে, সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রণয়নে সরকারকে বাধ্য করবে বিএনপির প্রতিটি স্তরে এই ধারণা একদম পাকাপোক্ত ছিল। সে জায়গা থেকে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে যুক্তরাষ্ট্রের মর্জিমাফিক রাজনৈতিক বিবৃতি প্রদান করে থাকে। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশ যেখানে ফিলিস্তিনের পক্ষে সে যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্যতার কারণে দলটি গাজায় নির্যাতিত শিশু ও নারীদের পক্ষে অবস্থান নিতে পারেনি। এ ব্যাপারটি দলের কর্মী সমর্থকরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। নিজেদের অস্তিত্ব বিকিয়ে দিয়ে ভিন্ন রাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে বিএনপির তৃণমূল কর্মীরা শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর বিরাগভাজন।
বিএনপির বোঝা উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে মিলিত হয়। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের যে সাম্রাজ্যবাদের নীতি এ ব্যাপারটি স্বাধীনতাকামী জনগণ কোনোভাবেই পছন্দ করতে পারে না। আমজনতার ধারণা যুক্তরাষ্ট্র যে দেশের প্রতি বিরাগভাজন থাকে সেখানে বুঝতে হবে রাষ্ট্রটি থেকে তাদের স্বার্থ উদ্ধার না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিরাগভাজন হয়ে উঠে। সাধারণ জনগণ এই অর্থে বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের ওপর অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপের কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে তারা স্বার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েও বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। তার মানে দাঁড়ায় সরকার সঠিক জায়গায় রেয়েছে এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ যথার্থ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ বিবেচনায় যৌক্তিক। এ ব্যাপারটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত এবং এতে জনগণের বোধোদয় হয়েছে।
সব নিয়ম কানুনকে পাশকাটিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকাকে বিএনপির রাজনীতির জন্য একটি জটিল সিদ্ধান্ত হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সরকার কিন্তু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সম্পন্ন করেছে সে কারণেই বিদেশিরা ভোটগ্রহণ সংক্রান্ত ইসু্যতে কোনো ধরনের অভিযোগ তুলে ধরেনি। বিভিন্ন সময়ে বলার চেষ্টা করেছে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি এবং সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন নিয়ে কথা বলার কোনোরূপ সুযোগ থাকতো না। কিন্তু নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তারা কোনো কথা বলেনি। তারা বলার চেষ্টা করেছে সব দল নির্বাচনে এলে নির্বাচন আরও গ্রহণযোগ্য হতো। বিএনপি যে কাজটি করতে পারত নিয়মমাফিক আয়োজনে বিএনপির উচিত ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে কমিশন যদি নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের জন্য কাজ করত তাহলে বিএনপির বর্তমান আন্দোলনে গতি আসত এবং তাদের আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে মূল্যায়ন হতো। দলের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হতো প্রবলভাবে এবং দলের আহ্বানে সব কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত।
বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সমাবেশের আয়োজন করে থাকে। সমাবেশে দেশের জেলাগুলো থেকে নেতাকর্মীরা ঢাকাতে এসে জড়ো হয় এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বক্তব্যে সরকারকে গদি ছাড়ার করার জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় দলের নেতাকর্মীরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং সহিংস ও উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে। তাছাড়া হরতাল অবরোধের ফলশ্রম্নতিতে দেশজুড়ে চলন্ত গাড়িতে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা, যানবাহন ভাঙচুর, আগুন, সরকারি সম্পদ ধ্বংস ইত্যাদি জনবিরোধী কার্যক্রম চালায় বিএনপির নেতা কর্মীরা। ফলাফল আসে হিতে বিপরীত, বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সাধারণ মানুষ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি রাজনৈতিক দলের উত্থানের পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থনের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প থাকে। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের ধ্বংসের জন্য হাতে গোণা দু'একটি কারণই যথেষ্ট। যখন একটি রাজনৈতিক দল একবার নয়, দুবার নয় বারংবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দল পরিচালনা করে তখন তার ধ্বংস অনিবার্য।
ভুল সিদ্ধান্তের কারণে প্রথমে জনসম্পৃক্ততা হারায় দলটি, এক সময় কর্মী সমর্থকরাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আজকের বিএনপিরও অবস্থা একই রকম। বারংবার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দলটি আজ বিলীনের দ্বারপ্রান্তে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে জামায়াত যে বিদেশি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল তাতে জোর সমর্থন ছিল বিএনপির। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপির বিদেশ নির্ভর রাজনীতি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বিএনপি ধারণা করেছিল হয়তো বিদেশিরা সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ করে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কিন্তু দলটির বোঝা উচিত ছিল বিদেশিরা নিজের স্বার্থ ব্যতীত কখনো এক পা সামনে বাড়ায় না। এভাবে বিদেশনির্ভর রাজনীতির ওপর মাত্রাতিরিক্ত অগ্রাধিকারের ফলে বিএনপির মাঠের রাজনীতি দিন দিন নষ্ট হয়ে গেছে। দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। আর বিএনপির আজকের করুণ দশার অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত বিদেশ নির্ভরতা। অতিমাত্রায় বিদেশ নির্ভরতার কারণে দলটি রাজনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে সাংগঠনিক ভিতকে মজবুত করা। দলের প্রতিটি পর্যায়ে গঠনতন্ত্র মেনে সাংগঠনিক কমিটি দিয়ে দল পরিচালনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সে জায়গা থেকে বিএনপি দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলেই দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করা উচিত। পরবর্তী সময়ে জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে কর্মসূচি ঘোষণা করা উচিত। আবার হালের সংস্কৃতিতে হরতাল অবরোধের মতো বিধ্বংসী কর্মসূচি জনগণ কোনোভাবেই সমর্থন প্রদান করেনি। সে জায়গা থেকে বিএনপি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বিএনপি প্রত্যাশা করেছিল দূতাবাসগুলোর ভূমিকাই মূলত তাদের ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে দেবে যেখানে দলীয় সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনগণের অংশগ্রহণকে তারা অগ্রাহ্য মনে করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়