নিজের ফেসবুক পাতায় সুইসাইড নোট পোস্ট করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষার্থী কুমিলস্নায় তার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এবং একজন সহকারী প্রক্টরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, কয়েকজন সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের মানসিক উৎপীড়নের কারণেই অবন্তিকা আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবন্তিকার ঘনিষ্ঠ অনেকে ফেসবুকে লিখেছেন ওই ঘটনার পর থেকে ব্যাপকভাবে মানসিক উৎপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন অবন্তিকা। এই ঘটনার পরদিনই একটি টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে এসে আরও একজন ছাত্রী তার বিভাগের শিক্ষকদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেন। ওই লাইভ অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সম্মানিত একজন সদস্যও যুক্ত ছিলেন। একটি ঘটনা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে এমনকি আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কেন সেটি এসব নির্যাতনের সঠিক সমাধান হয় না। এটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র- সবকিছুই তো এখন বিষাদগ্রস্ততা সরবরাহের পাইপলাইন। যার কারণে আদর্শবাদী রাজনীতি আত্মহত্যার জন্য যতটা না ব্যক্তিকে দায়ী করে, তার চেয়ে বেশি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের দিকেই আঙুল তোলে বেশি। এসবই কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিকে বাধ্য করে আত্মহত্যা করতে। আত্মহত্যা অবশ্যই হত্যা। অবন্তিকার সুইসাইড নোট পড়ে পরিষ্কার অনুমান করা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের দুর্বব্যবহার এবং মানসিক নির্যাতন তার আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। একজন শিক্ষক যেখানে শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেবে- সেখানে তিনি শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। মানসিক নির্যাতনের মাত্রাটি এত বেশি ছিল যে শিক্ষার্থী এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো। পরিবার, স্বজন, বন্ধুবান্ধুব, সহপাঠীদের ভাষ্যে জানা যাচ্ছে, প্রাণবন্ত তারুণ্যের একটা মানুষ ছিলেন অবন্তিকা। ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর-বাইরে সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজে ছিল তার সরব উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থাপনা করতেন হাসিমুখে। কয়েকদিন আগেও সে একটি আত্মহত্যা প্রতিরোধ সেমিনারের উপস্থাপনায় ছিলেন। ক্যাম্পাসের কুকুর-বিড়ালদের খাবার দিতেন, সেগুলো বিপদে পড়লে উদ্ধার করতেন। কিন্তু এমন প্রাণোচ্ছল মেয়েটিই আত্মহননের পথ বেছে নিলেন, এটি কী করে মেনে নেয়া যায়? আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নির্যাতিত হচ্ছে। তারা আবার আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে। বিষয়টি ভাবতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ন হতে পারে- তা সবার কাছেই অনুমেয়। নারী নিরাপত্তা, নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে অনেক গবেষণা চলছে। কিন্তু কোনোভাবেই কেন নারীদের যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে টেনেহিঁচড়ে নির্জনে নিয়ে নির্যাতন এবং ধর্ষণের ঘটনাও প্রায়ই আমরা শুনতে পাই। এ থেকে কি এটি প্রমাণ করে না যে, আমরা জাতি হিসেবে কতটা নিকৃষ্ট উপস্থাপিত হচ্ছি। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়ে তার প্রতিকার না পেয়ে দুঃখ, গস্নানি আর বিষণ্নতায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়- তাহলে আমরা জাতি হিসেবে কীভাবে এর দায় এড়াব? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে আত্মহনন করে তার নিজের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখতে হয়- এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন নারী। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার আকেজন নারী। সেই দেশ এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী ন্যায়বিচার কেন পাচ্ছেন না- সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। নারীদের জন্য নিরাপদ শহর ও নিরাপদ রাস্তার দাবি অনেক দিনের। দীর্ঘদিন থেকে এ নিয়ে আন্দোলন, সংগ্রাম ও প্রতিবাদ চলছে। আমি নিজেও এসব বিষয় নিয়ে অনেক লিখেছি, বলেছি। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদেও অনেকবার লিখেছি। একজন নারীকে নির্যাতন করে যদি নিরাপদে থাকা যায়, যদি বিচার না হয়; তাহলে তো নির্যাতকরা বেপরোয়া হবেই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নির্যাতনবিরোধী কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এমনকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেমন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, নারী কিংবা শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এই নীতি গ্রহণ করার সময় এসেছে। নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং উদ্যোগ গ্রহণের পরেও যখন আগের বছরের তুলনায় পরের বছর নির্যাতনের ঘটনা বেশি হয়, এমনকি কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়- তখন তা কতটা আশঙ্কাজনক এবং উৎকণ্ঠার বিষয় তা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে আইন আছে। এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। তারপরও অবন্তিকাকে কেন পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো- সেটি গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। অভিযুক্ত এসব দ্বীন ইসলামরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যলয়েই আছে। তারা ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এমনকি ভয় দেখিয়ে অসংখ্য ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করছে এই ধরনের মানবিকতা বিবর্জিত পাপী শিক্ষকরা। এদের শাস্তি নিসন্দেহে মৃতু্যদন্ড হওয়া উচিত। আগে শুনেছি নারীরা নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হলে সেখানেও তারা শ্লীলতাহানির শিকার হতো। এখন দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যিনি সহকারী প্রক্টরের দায়িত্বে রয়েছেন, তিনিও সেই ধরনের নোংরা সুযোগ নিতে প্রস্তুত থাকছেন। এ বিষয়ে নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। আমি একজন বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত এবং বিব্রত। এমন ঘটনার নজির আরও রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ হলে সংশ্লিষ্টরা সাময়িক বরখাস্ত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চূড়ান্তভাবে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না। এমনকি দেখা গেছে যে, নির্যাতিতের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা পেতে হয়রানির শিকার হতে হয়। নানা কটূক্তি ও ভয় প্রদর্শন করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেই। তাহলে কীভাবে তারা জনগণের আস্থা অর্জন করবে? রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের উচ্চমহল থেকে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও কেন এমন নিপীড়নের ঘটনা চলছেই- সেটির উত্তর খুঁজে দেখতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকে নৈতিক দায়বদ্ধতা হিসেবে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং তা দ্রম্নত প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে না পারলে উলিস্নখিত শঙ্কাটি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ংঁষঃধহসধযসঁফ.ৎধহধ@মসধরষ.পড়স