রোজার সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের দাম। ফলে সীমিত ও নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। রমজানে পণ্যের দাম আরও বাড়বে এমন শঙ্কায় দিশেহারা সাধারণ মানুষ। হঠাৎ দামের এমন ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়ছেন খেটেখাওয়া লোকজন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরকার-সিন্ডিকেটের পাল্টাপাল্টি দোষারোপে পৃষ্ঠ হচ্ছে জনগণ। ২৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০২৪ (বুধবার) সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রকাশিত পণ্য তালিকায় দেখা যায়, গত এক মাসের ব্যবধানে গরুর মাংস, ব্রয়লার মুরগির মাংস, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, হলুদ, দারুচিনি, তেজপাতা ইত্যাদি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সিন্ডিকেটের কারণে ব্রয়লার ও গরুর মাংসের দাম কমছে না। এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় খোলা বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের সর্বোচ্চে দাম ছিল ৭২০ টাকা। বুধবার সেটি বিক্রি হতে দেখা গেছে ৭৫০ টাকা দরে। একইভাবে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৯৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। গত এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম গড়ে প্রায় ২১ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া ছোলার দাম পাঁচ শতাংশ, ডালের দাম দুই শতাংশ, শুকনা মরিচের দাম পাঁচ শতাংশ, হলুদের দাম চার শতাংশ, দারুচিনির দাম পাঁচ শতাংশ এবং তেজপাতার দাম কেজিতে গড়ে প্রায় তিন শতাংশ বেড়ে গেছে। উচ্চ শুল্কের কারণে আকাশচুম্বী হয়েছে চিনি ও খেজুরের দাম। চলতি অর্থবছর থেকে এনবিআর খেজুরকে বিলাসী পণ্য হিসেবে মূল্য ধরছে। ফলে আমদানি করা ১২০ টাকা কেজি দরের খেজুরে ২১০ টাকা শুল্ক দিয়ে বর্তমানে ৩৩০ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি কর হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, রমজান উপলক্ষে যেন নতুন করে এসব পণ্যের দাম আর না বাড়ে, সেজন্য চলতি মাসের শুরুতে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের আমদানি কর কমিয়ে দেয় সরকার। চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। একইভাবে ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতেও কর কমিয়ে দিয়েছে, রমজান উপলক্ষে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পাম তেল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে কোনো সংকট নেই। কিন্তু কিছু 'অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ' বাড়তি মুনাফা পেতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি বন্ধে দ্রম্নত ব্যবস্থা না নিলে রমজানে মাসে বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। পক্ষান্তরে ব্যবসায়ীদের মতে ডলারের মূল্য ও পরিবহণ খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে নানা জটিলতার কারণে সার্বিকভাবে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের বাজারে ইতোমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসেরই দাম বেড়ে গেছে। অফিসিয়ালিভাবে ডলারের মূল্য ১১০ টাকা হলেও ব্যবসায়ীদের কিনতে হয় ১২৩-১২৫ টাকা দিয়ে। আমদানির ক্ষেত্রে সরকার সম্প্রতি যতটুকু শুল্ক কমিয়েছে, সেটি এর দাম কমানোর জন্য যথেষ্ঠ নয়। মোদ্দাকথা দ্রব্যমূল্যের দাম অতিরিক্ত পরিমাণে বাড়ানোর পর লোক দেখানোর জন্য কিছু পরিমাণ কমিয়ে ঢাক-ঢোল পিটায়ে বেড়ানোই বর্তমান রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরকার ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটদের ওপর দোষারোপ করে। আর তারা উল্টোভাবে সরকারকে দোষারোপ করে। মাঝখানে ছিঁড়ে চ্যাপ্টা হয় খেটেখাওয়া সাধারণ জনগণ। রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই দায়ভার কে নেবে এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রথাগত সরবরাহ প্রক্রিয়া অর্থাৎ অতিরিক্ত মজুতের মাধ্যমে পণ্যের কৃত্রিম সংকট দূর করার জন্য বাজার পর্যাপ্ত মনিটরিং করতে হবে। রমজানে বিভিন্ন পণ্যের বাড়তি চাহিদা সামনে রেখে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে তৎপর থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির বিষয়টি নতুন না হওয়ায় কর্তৃপক্ষের জোরালো নজরদারি অব্যাহত রাখা জরুরি। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আইন সংস্কার করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদন এবং পণ্য সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সরকার, সিন্ডিকেট এবং ব্যবসায়ী একে-অপরকে দোষারোপ না করে সমন্বিতভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সর্বোপরি সিন্ডিকেটের একচেটিয়া ব্যবসা পরিহার, ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লাভের মানসিকতা পরিবর্তন এবং সরকারের শুল্কহার আরও কমিয়ে ভর্তুকি প্রদান করা এখন সময়ের দাবি।