বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার ওপর প্রথম আঘাত আসে ইংরেজ আমলের ভুল নদী ব্যবস্থাপনায়। এরপর ষাটের দশকে সবুজ বিপস্নবের নামে ক্ষতিকর বাঁধ, আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীগুলোর ভালোর বদলে মন্দই করেছে বেশি। গত দুই দশকে শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নদীর দখল ও দূষণ ঘটেছে ব্যাপক হারে। নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, দূষণমুক্ত রাখা এবং দখল রোধে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আরও আছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। তবুও রক্ষা পাচ্ছে না নদীর দখল ও দূষণ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্রই আমরা ময়লা-আবর্জনা সব নদীতে ফেলছি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। উজান থেকে নেমে আসা পলি এসে পড়ছে নদীতে। ময়লা-আবর্জনার কারণে একদিকে যেমন জলজ প্রাণী হুমকিতে পড়ছে, অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখা উপনদী মিলে কম-বেশি ৭০০টি নদী রয়েছে। তবে দেশের শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮টি নদনদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে এখন মৃতপ্রায়। ৫৩ জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মতে নদী দখলদারদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আসলে সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নদীর ধারে গড়ে উঠেছে বড় বড় কলকারখানা, নদীতে শত শত বাঁধ। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবে নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে দখল করার উৎসবে মেতে উঠেছে। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ এখন এ কথা বলার আর কোনো উপায় নেই। এ দেশ এখন নদীবৈরী দেশে পরিণত হয়েছে।
দখলের কোনো কোনো ক্ষেত্রে দখলদারদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের একটি অংশ। বস্তুত দেশের সব নদী ও খালই দখলের শিকার হয়েছে। বছর তিনেক আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশে নদী দখলদার ও তাদের পরিচয় চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের ভেতরের ও আশপাশের নদী-খালগুলোর দখল এবং দূষণের বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ অশুভ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। দেশের সব নদী, বিল ও খালগুলোর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং দূষণবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি উচ্ছেদ অভিযানের পর আবারও যাতে দখলের প্রক্রিয়া শুরু না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দখলদাররা এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, তারা নদীতীরের সীমানা পিলার পর্যন্ত উপড়ে ফেলে দেয়।
দেশের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নানা রকম প্রভাব খাটিয়ে নদী ও খালের তীরবর্তী স্থান দখলে নিয়ে অনেকে বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রকম স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এমনকি নদীর তীরবর্তী স্থানে অবৈধভাবে হাটবাজারও বসানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নদী-খালের জমি দখলদারদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনীতির যোগসাজশ রয়েছে। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরকে নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধের সব ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ভূমি মন্ত্রণালয়কে জলাভূমির লিজ বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরকে জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। আর আন্তর্দেশীয় নদীতে পানির প্রবাহ বাড়াতে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। নদীর সীমানা নির্ধারণ, অবৈধ দখলদার চিহ্নিতকরণ, দখলদার উচ্ছেদ ও নদী উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কিছুই করা সম্ভব নয়। নদী বাঁচাতে আমরা যতই বুলি আওড়াই না কেন, রাজনীতিবিদদেরই এর প্রতিকার করতে হবে।
এজন্য নদী রক্ষাকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে নদনদী বাঁচাতে খুব দ্রম্নত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি যেমন ত্বরান্বিত করতে হবে, তেমনি এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। নদী দখল-দূষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আসলে দেশের অসংখ্য নদনদী ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে। এতে নদনদীগুলো ক্রমে ভরাট হয়ে স্বাভাবিক নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নদীগুলোর দুই তীর দখল হয়ে সেগুলো ধীরে ধীরে সর্পিলাকার ধারণ করছে। এসব নদনদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। এগুলোকে অবিলম্বে পুনঃখনন করতে হবে। নদী দখলদারদের যে কোনো মূল্যে উচ্ছেদ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ ছাড়া নদী দূষণ রোধ করতে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
দেশের নদনদী, জলাভূমি দখল ও দূষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন করা, নৌপথকে সচল রাখতে নদীগুলোকে খনন করা, নদী ও জলাভূমির দূষণ রোধে সব কারখানায় শিল্পবর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নির্মাণে সরকারকে অবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে অভিযোগ আছে, পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও কোনো কোনো কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি তা নদী ও পার্শ্ববর্তী খাল ও নর্দমায় ফেলে দেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করার সুযোগ তৈরি হয়। কাজেই নদী দূষণ রোধেও নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা।
সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে নদনদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে; নদনদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এতে বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। কোনো কোনো স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদার ভুয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও চালিয়ে যায়। তবে যেভাবেই দলিল করা হোক না কেন, কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিলে নদী রক্ষা আইন অনুযায়ী তীরের দখলকৃত জায়গা যে কোনো সময় উদ্ধার করা সম্ভব। দেশের সব নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সারা দেশের নদীগুলোর ভয়াবহ দূষণের বিষয়টিও বহুল আলোচিত।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যপরিধি বাড়ানোর জন্য ২০২০ সালে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এজন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন 'জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০২০' এর খসড়া সরকারের কাছে পেশ করেছিল কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এটি দীর্ঘ চার বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। ওই খসড়া আইনে নদীর দখল ও দূষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদন্ড বা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের নদী রক্ষা কমিশন আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য কোনো শাস্তি নির্ধারিত ছিল না।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সব নদ-নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করে নতুন আইনে প্রস্তাব করা হয়, নদী সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা, অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দেশের সব নদনদীর দূষণ ও দখলমুক্ত করে স্বাভাবিক নৌচলাচলের উপযোগী করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ, উন্নয়ন, শ্রীবৃদ্ধিসহ যাবতীয় উন্নয়নে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাধ্য থাকবে। সংশ্লিষ্টরা নদী রক্ষা কমিশনকে সঠিক এবং যথাযথ সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে বাধ্য থাকবে।
আগের আইন অনুযায়ী, নদীদূষণ ও দখল রোধে সুপারিশ করা ছাড়া নদী রক্ষা কমিশনের কোনো কাজ ছিল না। প্রস্তাবিত নতুন আইন অনুযায়ী, কমিশন নদী দখল ও দূষণ রোধ এবং নদীর উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেবে। এ নির্দেশনা মানতে সংস্থাগুলো বাধ্য থাকবে। সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। তাছাড়া খসড়া আইনে নদী সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য 'নদী রক্ষা কোর্ট' গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।
বর্তমান কমিশন আইনে নদী দখল ও দূষণকারীদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট শাস্তির কথা নেই। তবে দন্ডবিধিতে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার শাস্তির কথা আছে। পরিবেশ আইনেও নদী দখল-দূষণের বিষয়ে শাস্তির বিধান আছে। পানি আইনেও নদী সংক্রান্ত অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু নদীর ক্ষেত্রে এই আইনগুলোর বাস্তবায়ন তারা করেনি। নদী দখল ও দূষণের জন্য কাউকে কারাদন্ড পেতে হয়নি। শুধু কিছু জরিমানা করা হয়েছে। নতুন কমিশন আইনে ওই আইনগুলোর শাস্তির বিষয়গুলো উলেস্নখ করা থাকবে। একই সঙ্গে নদী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। আইনের প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ব্যর্থ হলে জবাবদিহি করতে হবে কমিশনের কাছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা এমনকি ক্রিমিন্যাল অ্যাকশনও নেওয়া যাবে। কমিশন এই ব্যবস্থা নিতে পারবে।
আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গে আমাদের নদীগুলো ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। হাজার বছর ধরেই এসব নদনদী আমাদের কৃষি, প্রকৃতি ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। নদী রক্ষা না করলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা পাবে না। একজন মা যেমন তার সন্তানকে পরিচর্যা করেন এবং খাবার খাইয়ে বড় করে তোলেন, নদীও প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। নদীগুলো আমাদের ধারণ করে আছে মায়ের মতো। এই মা ভালো না থাকলে আমরা কেউই ভালো থাকব না। তাই নদী ও পরিবেশ বাঁচাতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।