বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে প্রজ্বলিত থাকবেন

মোহাম্মদ হোসেন
  ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
বঙ্গবন্ধু প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে প্রজ্বলিত থাকবেন

১৭ মার্চ বাঙালির এক অপার আনন্দের দিন। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বিশ্ববন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৫তম জন্মদিন জাতি উদ্‌যাপন করছে। ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৭ মার্চ রাত ৮টার দিকে মা সায়েরা খাতুনের কোল আলোকিত করে আসেন ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালি ও বাংলাদেশের মুক্তিদাতা মহান পুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষকে সাহস জুগিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি দিয়েছে। নিজের জন্মদিন নিয়ে কোনো দিন আলাদা করে ভাবার কোনো প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তার মনে একক ভাবনা, মানবতার কল্যাণ কামনা। তার জন্মদিনে তার কাছ থেকে মানবতার সেবা ও জয়গান আমাদের প্রাপ্তি। শৈশবে রাস্তার পাশে শীতে কাতর হওয়া বৃদ্ধের গায়ে নিজের চাদর জড়িয়ে দিয়ে, দুর্দশাপীড়িত মানুষের মনে সাহস জোগাতেন তিনি। ১৯৩৭ সালে মুষ্টিভিক্ষা করে 'মুসলিম সেবা সমিতি'র মাধ্যমে গরিব ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ান তিনি। জন্মদিনে এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, 'আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?' প্রতিউত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার দ্বিধাহীন উত্তর, 'জনগণের সার্বিক মুক্তি।' তাহলে দাঁড়ায় প্রতিটি মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, মুক্তির প্রতিটি নিঃশ্বাসে জন্মে থাকেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। তিনি জনগণ ও শাসকশ্রেণির অভিপ্রায় বুঝতে পারতেন। ছাত্রজীবন থেকে জনগণের পাশে থাকা তার রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ভাষণ, বক্তৃতা, সভা সমাবেশ ও সেমিনারে সক্রিয় ছিলেন। ফলে জনগণের সঙ্গে তার যোগাযোগের ক্ষমতা ছিল অনন্য সাধারণ। সহজ-সাবলীলভাবে তার অন্তরের কথাগুলো জনগণকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন।

'ইতিহাসের মহানায়ক' হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে জন্মগ্রহণ করেন না। যুগযুগান্তরের পরিক্রমায় হাতেগোনা দু'একজন মানুষই শুধু 'ইতিহাসের মহানায়ক' হয়ে ওঠতে পারেন। ইতিহাস তার আপন তাগিদেই সৃষ্টি করে মহানায়কের। আর সেই 'মহানায়ক'ই হয়ে ওঠেন তার কালের প্রধান কারিগর ও স্থপতি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনই একজন কালজয়ী মহাপুরুষ, যিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আবার সেই স্বপ্নের 'স্বাধীন বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক পত্রিকা শেখ মুজিবুর রহমানকে 'রাজনীতির কবি' বলে আখ্যায়িত করে লেখে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হলে প্রকৃত দেশপ্রেম নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে আমাদের সবাইকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। সেটাই হবে জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ উপায়। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বকে হিমালয় পর্বতমালার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, 'আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়াজ। আই হ্যাভ হ্যাড দ্য এক্সপেরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।' ২০০৪ সালের বিবিসি বাংলা সারা বিশ্বে জরিপ চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত করে। ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে কূটনীতিকরা তাকে 'ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড' আখ্যা দেয়।

১৯৯৭ সাল থেকে তার জন্মদিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে সাহসী উপস্থাপনায় সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ন্যায্য দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়ে যিনি কিশোর ছাত্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষে অজস্র সহায়হীন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্যে করেন তিনি। ১৯৪৬-এর দাঙ্গা প্রতিরোধে অগ্রণী যে কণ্ঠস্বর, ১৯৪৮ ও ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখের বুলিতে নতুন করে জন্ম নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৩ অবহেলিত বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের একুশ দফা থেকে স্বাধীনতার সূর্য হয়ে তিনি জন্মেছেন। '৫৮, '৬৬, '৬৯, '৭০, '৭১- এই যে ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলার মানুষের স্বাধীনতা-স্বাধিকারে বেঁচে থাকার প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা হয়ে তিনি মিশে আছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তার ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা বাংলাকে '৭২ থেকে '৭৫-এর প্রতিটি দিনের পরিশ্রমে নতুন জীবন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটা সত্যি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, কিন্তু সেই দিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি দিনে তিনি জন্মেছেন। তিনি প্রতিদিন জন্ম নেন সব শুভচিন্তায় ও কর্মে। বোধশক্তি হওয়ার পর এমন কোনো দিন ছিল না যে তিনি বাঙালির জন্য আত্মনিবেদন ও আত্মত্যাগ করেননি। বাংলার মানুষের হাসি-আনন্দে প্রতিদিন জন্ম হয় তার।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়। যারা হত্যাকান্ড ঘটায়, তারা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। কিন্তু চক্রান্তকারীরা জানে না বঙ্গবন্ধু কখনো মরে না, বঙ্গবন্ধু মানুষের হৃদয়ে আজীবন প্রজ্বলিত হয়ে থাকবেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর শরীর থেকে যে রক্ত ওরা ঝরিয়েছে, সেই রক্তেই আবার নতুন করে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। হন্তারকের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের দেহ থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে বাংলার অবারিত প্রকৃতি, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে আরও বেশি করে জেগে উঠেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু নিজের সবকিছুই জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অন্যের দুঃখ-কষ্ট তাকে সর্বদাই আবেগাপস্নুত করত। এক জনসভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেছিলেন, 'একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে, আমি যখন ভাবী দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে একনজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে!' অবহেলিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত, অত্যাচারিত প্রতিটি মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। সেটি প্রতিফলিত হয়েছে তার প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। তিনি শুধুই যে বাঙালির জন্য ভাবতেন তা কিন্তু নয়, তার চিন্তা ও চেতনাবোধ ছিল বিশ্বজনীন। ইনিই তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। অতি সাধারণ ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃতু্য থেকেছেন। ধানমন্ডিতে যখন পস্নট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন ভালো একটি পস্নট নেওয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, 'আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে, তখন দেখা যাবে।' আবার বঙ্গবন্ধুই ১৯৭৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।' বাঙালির মুক্তির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৫তম জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন করছি।

পৃথিবীর ইতিহাস যত দিন থাকবে, বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে একইভাবে প্রজ্বলিত থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে এবং পথ দেখাবে।

বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের কালজয়ী এই মহাপুরুষকে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

মোহাম্মদ হোসেন : ডেপুটি রেজিস্ট্রার (তথ্য), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে