পাঠক মত

শিশু আয়ান ও আহনাফের মৃতু্য- এ দায় কার

প্রকাশ | ১৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

রায়হান আলী আইনজীবী, খুলনা
সুন্নাতে খতনা করতে গিয়ে দুই শিশুর প্রাণহানি ঘটনায় পুরো গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে বর্তমানে। সবচেয়ে যে বিষয়টি জনমনে বিস্ময় লেগেছে, সেটা হলো অতি সাধারণ একটি অস্ত্র অস্ত্রোপচার করা হয় য় আর সেই খতনা করাতেই দুইজন শিশুর মৃতু্য। প্রথম ঘটনাটি একমাত্র ছেলে আয়ান আহমেদকে খতনা করানোর জন্য গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যান বাবা শামীম আহমেদ। সেখানে অ্যানেন্থেসিয়া দেওয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি সাড়ে পাঁচ বছর বয়সি শিশুটির। ভুল চিকিৎসা ও হাসপাতালের অবহেলার কারণেই আয়ানের অকালমৃতু্য হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাবা শামীম আহমেদ। 'আমার ছেলেটার ঠান্ডার সমস্যা ছিল জেনেও তারা ফুলবডি অ্যানেন্থেসিয়া কীভাবে দিল? এ ছাড়া খতনা চলাকালে ৩০-৪০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীকে তারা দর্শক হিসেবে ওটিতে ঢুকালো। এটা কোন ধরনের ওটি?' ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন বাবা শামীম আহমেদ। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো-শিশু আয়ানের মৃতু্যর রেশ না কাটতেই এবার মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃতু্য হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই শিক্ষার্থীর নাম আহনাফ তাহমিন আয়হাম। স্বজনদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও তারা ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েছে। যে কারণে আহনাফের আর জ্ঞান ফেরেনি। ২০ ফেব্রম্নয়ারি রাত ৮টায় আহনাফকে সুন্নাতে করাতে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। এর ঘণ্টাখানেক পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সূত্র মতে, মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জন ডা. এস এম মুক্তাদিরের তত্ত্বাবধানে মঙ্গলবার রাতে সন্তানকে সুন্নাতে করাতে আসেন শিশু আয়হামের বাবা ফখরুল আলম ও মা খায়কুন নাহার চুমকি। রাত ৮টার দিকে করানোর জন্য অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পর আর ঘুম ভাঙেনি আহনাফের। এর ঘণ্টাখানেক পর হাসপাতালটির পক্ষ থেকে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। স্বজনদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয় আহনাফকে। যে কারণে তার জ্ঞান ফেরেনি। আহনাফের বাবা ফখরুল আলম বলেন, আমরা চিকিৎসককে বলেছিলাম যেন, ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। এরপরও আমার ছেলের শরীরে সেটি পুশ করেন ডাক্তার মুক্তাদির। আমি বারবার তাদের পায়ে ধরেছি। আমার ছেলেকে যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আমার সন্তানকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই মৃতু্যর দায় মুক্তাদিরসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবারই। আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই। (তথ্য সূত্র- যুগান্তর, ২১ ফেব্রম্নয়ারি,২০২৪)। একটা সময় ছিল যখন অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার করা হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেটি বদলে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, 'এতে নির্বিঘ্নে অস্ত্রোপচার করে ফেলা যায়।' অ্যানেস্থেসিয়ার একাধিক ধরন রয়েছে। যেমন, শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অংশে ছোট অস্ত্রোপচার করার সময় কেবল ওই অংশটিকেই অবশ করা হয়। এটি 'লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া' নামেই বেশি পরিচিত। ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া জানান, 'মূলত রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে এসব পরীক্ষা করা হয়। কোন ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া তার জন্য নিরাপদ হবে, এর মাধ্যমে সেটি বোঝা যায়।' কাজেই কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শরীরে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হলে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন, এমনকি মৃতু্য পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান তিনি। শিশু আয়ানের মৃতু্য-সংক্রান্তে ৯ জানুয়ারি জনস্বার্থে স্বপ্রণোদিত হয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবিএম শাহজাহান আকন্দ মাসুম হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। রিটে এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রুল জারির আবেদন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় জড়িত ডাক্তারদের সনদ বাতিল চাওয়া হয়েছে। ৯ জানুয়ারি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আয়ানের মৃতু্যর ঘটনায় ২৯ জানুয়ারি জমা দেওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। প্রতিবেদনটিতে 'আইওয়াশ' হিসেবে উলেস্নখ করে এতে করা সুপারিশগুলো 'হাস্যকর' বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি আতাবুলস্নাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিট আবেদনের শুনানিতে বলেন, 'আমরা চিকিৎসক নই। তবে আমরা মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি। এটা বোঝা যাচ্ছে যে, আপনাদের (সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের) অবহেলা ছিল। কোনো ধরনের তদন্ত না করেই তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বাইপাস সার্জারির জন্য সাধারণত এত বিপুল মাত্রার ওষুধের প্রয়োজন হয় না।' 'চিকিৎসকরা তার (আয়ান) ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে জানতে পারার পরও কেন এত তাড়াহুড়ো করে তার করা হয়েছিল? অপারেশনের জন্য তারা কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারতেন।' ১৫ জানুয়ারির আদেশ অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) তুষার কান্তি রায়ের মাধ্যমে ১৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি বলেছে, অপারেশনের কারণে আয়ানের স্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং সিপিআরের (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) কারণে তার পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়ে থাকতে পারে। ডিএজি হাইকোর্ট বেঞ্চে তদন্ত প্রতিবেদনের কিছু অংশ পড়ে শোনানোর পর রিট আবেদনকারী আইনজীবী শাহজাহান আদালতকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে কারসাজি করা হয়েছে। তিনি আয়ানের মৃতু্য নতুন করে তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে নতুন করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শিশু আয়ান ও আহনাফের মৃতু্যতে দায় নেবে কে- এমন প্রশ্ন আমার মতো অনেকের। দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০-এর ৮০ ধারায় বলা আছে-'কোনো আইনানুগ কাজ আইনানুগ পদ্ধতিতে আইনানুগ উপায়ে যথোপযুক্ত সতর্কতা ও যত্নসহকারে সম্পাদন করাকালে কোনো অপরাধমূলক উদ্দেশ্য বা অবগতি ছাড়া দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যক্রমে অনুষ্ঠিত কোনো কিছুই অপরাধ বলে পরিগণিত হবে না'। উক্ত আইনের ৮৮ ধারায় বলা আছে- 'যে ব্যক্তির উপাকার হবে বলে আন্তরিক সদিচ্ছা বা সরল বিশ্বাস হতে কোনো কাজ উক্ত ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত কার্যভূত ক্ষতি স্বীকার বা ক্ষতির ঝুঁকি স্বীকারমূলক সম্মতিক্রমে মৃতু্য ঘটাবার উদ্দেশ্য ছাড়া উক্ত ব্যক্তির উপকারার্থে সম্পন্ন হয়-কার্যটি সম্পাদনের পর এতে কোনোরূপ ক্ষতিসাধিত হওয়ার ফলে অথবা যিনি কাজটি সম্পন্ন করলেন, তিনি উহাতে যে ক্ষতি করার ইচ্ছা করেছিলেন, যে ক্ষতি হওয়ার ফলে অথবা যিনি কাজটি সম্পন্ন করলেন, উহাতে সম্ভবত সে ক্ষতি হতে পারে বলে জানতেন, তা হওয়ার ফলে কাজটি অপরাধ হবে না'। উলেস্নখিত আইন দুটি পর্যালেচনায় এটা বুঝতে পারি যে, ডাক্তার যদি সরল বিশ্বাসে ও উপকারার্থে এ কাজ করে থাকেন, তাহলে ডাক্তারের কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু যদি ডাক্তারের অবহেলাজনিত কারণে শিশু আয়ান ও আহনাফের মৃতু্য ঘটে, তাহলে ডাক্তার দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০-এর ৩০৪ (এ) ধারামতে অপরাধ করেছে মর্মে প্রাথমিকভাবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ রিপোর্ট প্রদান করবে। আর সে মোতাবেক মামলার বিচারান্তে ডাক্তারের অবহেলার বিষয়টি সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হলে, সে ক্ষেত্রে অপরাধীর সাজার বিধান আছে- পাঁচ বছর পর্যন্ত মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা অর্থদন্ড অথবা উভয়বিধ দন্ডেই দন্ডিত হবে। আমাদের দেশের চিকিৎসা খাত নিয়ে জনমনে নানান অভিযোগ। দেশীয় চিকিৎসা সেবার মান নিয়েও অনেকের কাছে প্রশ্ন, তাই বিদেশি চিকিৎসাসেবা নিতে মানুষ প্রতিনিয়তই ভারতে ছুটে যাচ্ছেন। কিছু কিছু অসৎ ডাক্তারের রোগীর টেস্ট বাণিজ্য ও কিছু কিছু অনভিজ্ঞ ডাক্তারের দ্বারা অপারেশনে রোগীর প্রাণহানি ও ক্ষতি চিকিৎসা খাতে অনেকটা বদনাম ছড়াচ্ছে। বেশিরভাগ প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক, হাসপাতালে সরকারি ডাক্তাররা চিকিৎসাসেবার কাজ করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে হয়ত বা সরকারি অফিস টাইমের বাইরে প্রাইভেটে সময় দেওয়ার কথা কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটুকু হচ্ছে, সেটাই প্রশ্ন। সময় বাঁচাতে অনেক সময় তাড়াহুড়ো করে কোনো অপারেশন কিংবা রোগীর প্রেসক্রিপশন করতে গিয়ে ডাক্তাররা অনেক সময় ভুল চিকিৎসা করে থাকেন। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রোগী কিংবা রোগীর জীবন। হাজারও অভিযান চালানো হলেও কোনোক্রমেই কমছে না অনুমোদনহীন বেসরকারি হাসপাতালের দৌরাত্ম্য। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছেন, রাজধানীসহ দেশের আনাচে-কানাচে ১২শ'র বেশি বেসরকারি হাসপাতাল চলছে নিবন্ধন ছাড়াই। এসব অবৈধ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা থাকেন জীবন-মরণ সংকটে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি পদক্ষেপ বৃদ্ধি ও চিকিৎসকদের চিকিৎসা-সংক্রান্তে দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে রোগী হয়রানি ও অকালে রোগী মৃতু্যর হার কমে আসবে। রায়হান আলী আইনজীবী, খুলনা