বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আগুন আমাকে, আপনাকে খুঁজছে

অলিগলিতে/চিপাচাপায় নির্মিত আট/দশতলা ভবনগুলোতে আগুন লাগলে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মাত্রই বুঝার কথা। আগুন আমাকে, আপনাকে খুঁজবে না, কাকে খুঁজবে? নিরাপদ ভবন নির্মাণ, পরিবেশবান্ধব নগরায়নের প্রয়োজন বোধ না করলে যে পরিণতি অনিবার্য হয়, সে পরিণতিই ভোগ করছি। প্রায় দুই যুগ আগে একটা চলচ্চিত্রের নাম ছিল 'পালাবি কোথায়'। এখন মনে হচ্ছে আগুন বলছে, পালাবি কোথায়?
জহির চৌধুরী
  ১৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আগুন আমাকে, আপনাকে খুঁজছে

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা বেইলি রোডস্থ সাততলা বিশিষ্ট গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। অতীতে সংঘটিত এ ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোর মতো এ ঘটনা নিয়েও আলোচনা-বিশ্লেষণ, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি লক্ষ্য করা গেছে। বিষয়টি নিয়ে লেখার আগ্রহ থেকে ভাবছিলাম কি লেখা যায়। কি লেখা যায় ভাবছিলাম এ কারণে, লেখায় যা বলব বা লিখব, তার প্রায় সবই বিগত দিনে এ ধরনের অগ্নিকান্ডের পর বিভিন্ন লেখায় বলা হয়েছে; ফলে নতুন কি লেখা বা বলা যায় তা ভাবছিলাম। অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত/ক্ষতিগ্রস্ত ভবন বিধিমোতাবেক নির্মাণ করা হয়নি, ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না, থাকলেও কার্যকর ছিল না, তদরকি সংস্থাগুলোর দুর্নীতি, গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই বা হওয়া জরুরি কথাগুলোই ঘুরেফিরে এ ধরনের অগ্নিকান্ডের পর আলোচনায়, লেখালেখিতে উঠে আসে বা উঠে আসতে দেখা যায়। চর্বিত চর্বণে কি ফায়দা হবে- এমনটা যখন ভাবছি তখন একটি জাতীয় দৈনিকের অন লাইন ভার্সনে 'জেগে উঠুন, আগুন আপনাকেই খুঁজছে' শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটি চোখে পড়ে। শিরোনামের 'আগুন আপনাকেই খুঁজছে' অংশ দেখে রক্ত হিম হওয়ার অবস্থা। কয়েক মুহূর্ত ভাবার পর মনে হলো আসলেই আগুন আমাকে/আপনাকে খুঁজছে, ভাগ্যের জোরে এখন পর্যন্ত নাগাল পায়নি ; কয়দিন নাগালের বাইরে থাকা সম্ভব হবে ওপরওয়ালাই জানেন।

৩ মার্চ চোখে পড়ে দৈনিক কালেরকণ্ঠে প্রকাশিত 'আগুনের ঝুঁকিতে ঢাকার বেশিরভাগ ভবন' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি। সে প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বেইলি রোডে সাততলা ভবনে অগ্নিকান্ডে ৪৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ঢাকার অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়টি সামনে এসেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ ভবন আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৬০২টি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকার এক হাজার ২০৯টি প্রতিষ্ঠানে জরিপ চালিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ১২০৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০২টি অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ মানে ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ। ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হলে আমি/আপনি আগুনের ঝুঁকির মধ্যেই যে আছি, তা পরিষ্কার।

\হমনে করা যায়, অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা/হার আরও বেশি। কারণ, এটা নিশ্চিত যে, রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্মিত আবাসিক/বাণিজ্যিক বহুতল ভবনের যৎসামান্য বাদে সবই অনিরাপদ প্রমাণ হবে নিরাপদ ভবনের মানদন্ডে বিচার করলে। কে না জানেন যে, ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে নির্মিত বহুতল ভবনগুলোর বেশিরভাগই জননিরাপত্তা-জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রেখে তৈরি করা নকশা অনুযায়ী নির্মিত নয়, এসব ভবন ব্যবহারেও অগ্নিঝুঁকি মাথায় রাখা হয় না। ৩ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের 'ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হলেও ব্যবস্থা নেই' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রাজধানীজুড়ে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় কয়েক লাখ ভবন। রাজউকের মতে, রাজধানীর ৬০-৭০ ভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনুমোদনহীন'। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অনিরাপদ ভবন নির্মাণ ঠেকানোর দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা রাজউক। এ সংস্থাই বলছে, রাজধানীর ৬০-৭০ ভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনুমোদনহীন। ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনুমোদনহীন ভবনগুলো বছরের পর বছর সময় নিয়ে আমার/আপনার, রাজউকের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনুমোদনহীন ভবন চোখের সামনে গড়ে উঠা এখনো বন্ধ নেই। বহুমাত্রিক ঝুঁকির মধ্যেই বাস করছি -এটা বাস্তবতা।

একই দিন প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর 'ঢাকার ৯০ শতাংশ ভবনে নকশার বিচু্যতি' শিরোনামের প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, 'রাজধানীর অনুমোদিত ভবনগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ নকশায় বিচু্যতি করা হয়েছে। কোনো ভবনের চারপাশে খালি জায়গা না ছেড়ে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আবার কোথাও ফায়ার এক্সিট রাখা হয়নি। কেউবা অফিসের অনুমোদন নিয়ে রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছেন। অনুমোদনের চেয়েও বেশিতলা নির্মাণের ঘটনাও অহরহ। বছরের পর বছর এসব বিচু্যতি হলেও তা প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ কারণে ঢাকার ভবনগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠছে, প্রায়ই বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে।' এ প্রতিবেদনের মর্ম কথা বলা যায়, নিরাপদ বসবাস, ব্যবসা-অফিস কার্যক্রম চালানোর জন্য নির্মিত বহুতল ভবনগুলোর বেশিরভাগই মৃতু্য ফাঁদ, এগুলো সচেতনভাবেই তৈরি অব্যাহত রাখা হয়েছে। এসব মৃতু্য ফাঁদে প্রায়ই বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হচ্ছে নির্ধারিত পরিণতির ফলস্বরূপ। এ দেশে বহুতল ভবনধস, বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে কয়েকদিন 'আদাজল গিলে' আলোচনা-সমালোচনা করা, উপদেশ-পরামর্শ দেওয়া প্রথার মতো। এভাবে দায়িত্ব শেষ করা, মিডিয়ায় চেহারা দেখিয়ে প্রচার-প্রচারণার কাজ সারার চিত্রই এ যাবত লক্ষণীয়।

নগরায়ন ও ভবন নির্মাণে জনস্বাস্থ্য-জননিরাপত্তা এদেশে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়, তা দুনিয়ায় নজিরবিহীন। মধ্যযুগের এক কবি তার এক কবিতায় লিখেছেন, 'তুমি লাগিয়েছ ফণিমনসা/এখন বললে তো হবে না গাছে এত কাঁটা এলো কি করে?' আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত কাঁটার গাছ ফণিমনসা রোপণ করে কাঁটাশূন্য ফণিমনসা গাছ আশা করা যায় কি? যায় না। অনিরাপদ নগরায়ন/ভবন নির্মাণ উৎসাহিত করে, অনিরাপদ নগরায়ন/ভবন নির্মাণের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সহযোগী হয়ে অঘটন রোধের আশাও করা যায় না। সম্প্রতি জানা গেছে, অনঅনুমোদিত বেআইনিভাবে নির্মিত ভবন জরিমানার মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হবে। জরিমানা যদি জননিরাপত্তা/জনস্বাস্থ্য হুমকিতে ফেলার, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের বিচার হয়, তাহলে কাঠামোগত হত্যাকান্ড, পরিবেশ বিপর্যয় রোধ সম্ভব হবে না/হতে পারে না। ঝুঁকিমুক্ত/নিরাপদ ভবন আমরাই চাইছি না। পরিকল্পিত নগরায়নের প্রচেষ্ঠা বিভিন্ন সময় নেওয়া হলেও সাফল্য আসেনি ব্যক্তি-গোষ্ঠীর বাধা, স্বার্থ রক্ষা নীতির কারণে। দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক চেষ্টার পর বছর দুয়েক আগে চূড়ান্ত করা হয়েছিল ডিটেইলড এরিয়া পস্ন্যান (ড্যাপ)। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষের চাপ/বাধা/বিরোধিতার জেরে প্রায় আড়াই বছর আগে প্রস্তাবিত ড্যাপ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েও বাস্তবায়ন করা যায়নি। প্রস্তাবিত ড্যাপ সংশোধনে সরকারকে প্রকারন্তরে ঘাড় মটকিয়ে বাধ্য করেছে ব্যক্তি/গোষ্ঠী বিশেষ। সংশোধন-পূর্ব ড্যাপ আদর্শ নগরায়নের জন্য যথেষ্ঠ না হলেও মন্দের ভালো ছিল। সংশোধিত ড্যাপ অনিরাপদ নগরায়নের সহায়কই হয়েছে। সংশোধিত ড্যাপে ফার (উচ্চতা) এবং খালি জায়গা রাখার ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে অলিগলিতে আট/দশতলা ভবন নির্মাণের অবারিত সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস, জননিরাত্তা-জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি আরও বাড়াবে। অলিগলিতে/চিপাচাপায় নির্মিত আট/দশতলা ভবনগুলোতে আগুন লাগলে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মাত্রই বুঝার কথা। আগুন আমাকে, আপনাকে খুঁজবে না, কাকে খুঁজবে? নিরাপদ ভবন নির্মাণ, পরিবেশবান্ধব নগরায়নের প্রয়োজন বোধ না করলে যে পরিণতি অনিবার্য হয়, সে পরিণতিই ভোগ করছি। প্রায় দুই যুগ আগে একটা চলচ্চিত্রের নাম ছিল 'পালাবি কোথায়'। এখন মনে হচ্ছে আগুন বলছে, পালাবি কোথায়?

জহির চৌধুরী : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে