বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গ্যাস ও বিদু্যতের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে শুধু দেশের নিরীহ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে না। সরকারেরও দুর্নাম হচ্ছে। সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
ওসমান গনি
  ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
গ্যাস ও বিদু্যতের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

আবার গ্যাস ও বিদু্যতের দাম বৃদ্ধি করাটা যেন সাধারণ মানুষের মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই সারাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের মধ্যে একটা অস্থিরতা ভাব বিরাজ করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা চিন্তা করে এখন দেশের মানুষ বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে বেশি হতাশা বিরাজ করছে- যার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে একটা বিশাল পরিবর্তন এনেছে। টিকে থাকতে মানুষ যাপিত জীবনে খরচ কমিয়ে দিয়েছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, মাছ-গোশত খাওয়া, বিনোদন, স্বাদ-আহ্লাদ কমিয়ে দিয়েছে। পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির ঢেউ সারাদেশের সব জায়গায় সমানতালে বয়ে চলছে। যার কারণে কোনো মানুষই বাদ যায়নি এই অস্থিরতা থেকে। সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, জন্মদিন, খাতনা, বিয়েশাদি, মেজবান, নানামুখী উৎসব অনুষ্ঠানে লেগেছে এই অস্থিরতার ঢেউ। মানুষ এখন আর আগের মতো জমকালো অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ও বেশি লোকসমাগম করছে না কোন অনুষ্ঠানে। মানুষ এখন বিয়ে আয়োজনের ব্যয় সংকুচিত করে ফেলছেন। সামাজিক ও পারিবারিক আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ সীমাবদ্ধ রাখছেন। কেউ কেউ গিফট দেওয়ার সঙ্গতি না থাকায় সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকছে।

বৈদেশিক মুদ্রার ঊর্ধ্বগতি এবং সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নির্ধারিত আয়ের মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। কেউ ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন; কেউ খাবার কমিয়ে দিয়ে আয়-ব্যয়ের মধ্যের সমন্বয় রাখার চেষ্টা করছে। দেশের এই অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির ঢেউ সামাজিক আচার অনুষ্ঠান (জন্মদিন, খাতনা ইত্যাদি) বিয়েশাদি, চট্টগ্রামের মেজবান, নানামুখী উৎসব অনুষ্ঠানে লেগেছে। মানুষ এখন আর জমকালো অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকসমাগত করছে না। মানুষ এখন বিয়ে আয়োজনের ব্যয় সংকুচিত করে ফেলছেন। নিরুপায় হয়ে সামাজিক ও পারিবারিক, আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলছেন। যারা ধনাঢ্যদের মধ্যেও অনেকেই ব্যয় সংকোচনের নীতি অবলম্বন করছেন। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বোত্রই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। মানুষ এখন আর আগের মতো অনুষ্ঠানাদিতে 'এলাহি আয়োজনের' বদলে খরচ কমাতে সীমিত আয়োজন করছে।

সংসারের খরচ কমিয়ে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মানুষ। যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল তখন থেকে বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। কারণ জ্বালানির সঙ্গে ঘুরে দেশের সবকিছু। স্কুল, বাজার, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতে বাড়তি অর্থ গুণতে হচ্ছে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাস, নৌযান অর্থাৎ জ্বালানি তেলনির্ভর সব যানবাহনে বেড়েছে ভাড়া। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে অন্যান্য নিত্যপণ্যে। বাধ্য হয়েই কেউ শখ আহ্লাদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ সন্তানদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ ঘোরাঘুরি বাদ দিচ্ছে, কেউ আড্ডায় কম যাচ্ছে, কেউবা কম খাচ্ছেন।

করোনাপরবর্তী বিশ্বে যখন নিত্যপণ্য ও জ্বালানির দামে ঊর্ধ্বগতি, এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা পৃথিবীকেই ফেলে দিয়েছে বিরাট অনিশ্চয়তার মধ্যে। আর তারই ঢেউ যেমন বাংলাদেশে লেগেছে। দেশে দেশে মুদ্রার দরপতনে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, তার সঙ্গে বেড়ে যাওয়া খরচের সঙ্গে যখন নাভিশ্বাস, সে সময় জ্বালানি তেলের দামে দিল লাফ। সারের দাম বৃদ্ধিসহ সব পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতি। সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি সেক্টরে চলছে হা-হুতাশ। সার ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারাদেশের কৃষকদের মধ্যে চলছে নানারকমের হিসাব নিকাশ। কৃষকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, যে দেশে শতকরা ৮৫ জন লোক কৃষি পেশার সঙ্গে জড়িত সেখানে জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধি করা তার মানে হলো দেশের অর্থনৈতিক খাতকে ধ্বংস করে দেয়া। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির মানে হলো দেশের কৃষি খাতকে ধ্বংস করে দেয়া। যেখানে দেশের কৃষকরা কঠোর পরিশ্রম করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিল সেখানে এবারের জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক কৃষকই এ পেশা ছেড়ে বিকল্প পেশা খুঁজছেন। যদি কৃষকরা এ পেশা ছেড়ে দেয় তাহলে দেশ আবার খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে নিশ্চিত। তখন হয়তো ঘুরে দাঁড়ানোটা অনেক কষ্ট হবে।

বিভিন্ন পেশাজীবীদের কারোই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা নেই। কিছুদিন আগেও ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার এবং হোটেল-মোটেলে বিয়েশাদিসহ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বুকিং পাওয়া যেত না। এখন প্রায় খালি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহর বন্দর এলাকার কমিউনিটি সেন্টারগুলো। এমনিতেই মানুষ ব্যয়ের চাপে আছে, তার ওপর গ্যাস, বিদু্যৎ দাম বৃদ্ধি 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে সামনে এসেছে। মানুষ যখন একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়া নতুন করে বড় ধাক্কা দিচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে দেশের সব নিত্যসামগ্রীর ওপর। পারিপার্শ্বিক অনেক ব্যয় কাটছাঁট করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে দেশের মানুষ।

টান পড়েছে হোটেল, রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টারের আয়ে। এতে হোটেল, রেস্তোরাঁ কর্মীদের মধ্যে চাকরি হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্যবসাবাণিজ্যে এখন মন্দাভাব। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হিড়িক পড়েছে। এ অবস্থায় কৃচ্ছ্রতা সাধনের কোনো বিকল্প নেই। আর এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও কন্যার বিয়েতে ধুমধাম করছেন না। তিন দিনের বদলে একদিনেই শেষ হচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠান। তাতে অতিথির সংখ্যাও সীমিত করা হয়েছে। তার মতো অনেকে এখন বিয়েশাদির অনুষ্ঠান এভাবে সীমিত পরিসরে সারছেন। অভিজাত কমিউনিটি সেন্টারের বদলে অনেকে হোটেল, রেস্তোরাঁয় স্বল্পসংখ্যক অতিথির উপস্থিতিতে এসব সামাজিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করছেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে।

চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্যে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ব্যয় সংকোচন করেও সাংসারিক খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগান দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের। এ অবস্থায় আয়ের বিকল্প পথ খুঁজে চলেছেন পরিবারের কর্তা ব্যক্তিরা।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দুই বছরে দফায় দফায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে কয়েক দফা। গণপরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধি, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে লাগামহীন। এর সঙ্গে বেড়েছে বিদু্যৎ ও গ্যাসের দাম। বিশেষ করে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি সর্বস্তরের মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। সে তুলনায় আয় বাড়েনি। উল্টো কিছুক্ষেত্রে আয় কমেছে। এ অবস্থায় পারিবারিক খরচ মেটাতে ব্যয় সঙ্কোচন করতে হচ্ছে দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে। সাধ, আহ্লাদ বা আবশ্যক এমন অনেক কিছুই বাদ দিতে হচ্ছে হিসাবের খাতা থেকে। কারণ, বর্তমান আয়ে সংসারে প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই জমানো টাকা ভাঙিয়ে পারিবারিক ব্যয়ভার মিটিয়ে কোনোরকমে দিন পার করছে। ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট কমিয়ে দিয়েছে অনেক পরিবার। লেখাপড়ার খরচ মেটাতে না পেরে গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবারের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া চুকিয়ে ফেলছে বাধ্য হয়ে। এসব পরিবারের স্কুলপড়ুয়া ছেলেরাও এখন কর্মের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে অধিকাংশই অটোরিকশাকে বেছে নিয়েছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ও সংসারের চাহিদা মেটাতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাও প্রতিনিয়তই ছুটে চলেছেন নতুন কিংবা পার্টটাইম কর্মের সন্ধানে।

জ্বালানি তেলের আকস্মিক ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সামাজিক জীবনে নতুন করে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, সারাবিশ্বের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে পণ্যসামগ্রীর মৃল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। তা ঠিক, কিন্তু সরকার যে পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি করে তার ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী তার কয়েকগুন দাম বাড়িয়ে বাজারে মালামাল বিক্রি করছে। সরকারিভাবে দ্রব্যমূল্য যা বাড়িয়েছে তার কয়েকগুন বাড়িয়েছে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে। আর এ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা জাঁতাকলে পড়ে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন বেশিরভাগ বেকায়দায় পড়ছে। সরকারের উচিত দেশের স্ব স্ব এলাকার বাজারগুলোতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা।

সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে শুধু দেশের নিরীহ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে না। সরকারেরও দুর্নাম হচ্ছে। সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

ওসমান গনি :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে