প্রাচীন ভারতে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দে বুদ্ধ রাজা বা শাসকের জন্য 'দশরাজাধর্মের' কথা বলেছিলেন। তার মতে, রাজা বা শাসক শুধু জনগণের সেবক ও প্রতিনিধি। জনকল্যাণকে ব্রত করে রাজা বা শাসক তার সমস্ত কার্যাবলি সম্পাদন করেন; জনকল্যাণই রাজার একমাত্র লক্ষ্য, জনসেবাই রাজার মূল কর্ম। প্রাচীন গ্রিসেও প্রায় একই সময়ে তথা খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দে দার্শনিক পেস্নটো আদর্শ শাসকের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আদর্শ শাসক হবেন একজন দার্শনিক রাজা, যার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার থাকবে না। কারণ, এগুলো থাকলে একজন শাসক জনগণকে যে ধরনের প্রতিশ্রম্নতি দেন, সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন না। তিনি ব্যক্তিগত লোভে আসক্ত হয়ে পড়বেন। বুদ্ধ ও পেস্নটোর পর থেকে আধুনিক যুগের দার্শনিকরাও উত্তম শাসনের বিষয়ে ভেবেছেন। জনগণের ভাষায়, উত্তম রাষ্ট্র হবে সেই রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেয়। কার্ল মার্কস মনে করেন শ্রমজীবী মানুষের সরকারই উত্তম সরকার। আর এই উত্তম সরকার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুশাসন। বৃহত্তর অর্থে নাগরিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্য ভালোভাবে শাসন পরিচালনার নামই সুশাসন। আর কোনো রাষ্ট্রে যখন সামগ্রিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন দেশের পুরো ব্যবস্থাই (রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকব্যবস্থা) টেকসই উন্নয়ন ও পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। শাসন তখনই ভালো বা সুশাসন হয় যখন তা রাষ্ট্রস্থিত সব জনগোষ্ঠীর উপকার বা মঙ্গল করে। বর্তমান বিশ্বে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে- যার মূল নিয়ামক হচ্ছে সুশাসন। একটি বহুমাত্রিক ধারণা হিসেবে ১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংকের বদৌলতে সুশাসন ধারণারটার উন্মেষ ঘটে।
সুশাসন চিহ্নিতকরণে স্বায়ত্তশাসিত-সরকারি-বেসরকারি সব খাতের ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নের জন্য আইনিকাঠামো, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের ওপর জোর দেয়া হয়। সুশাসনের মাধ্যমে শাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদ ও সেবা বিতরণের ফলে দরিদ্রতম নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়। অর্থাৎ বৈষম্যহীনভাবে সবাই সমান সুযোগ, সেবা ও অধিকার ভোগ করবে। বাংলাদেশে রয়েছে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষ। এছাড়াও আছে নানা জাতিসত্তার মানুষ। এখন এ সব মানুষের কাছে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন না হলে সামাজিক অসন্তোষ বাড়বে। শুধু সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হলেই সুশাসন হবে না। যদি সংখ্যালঘু মানুষ স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে তার সম্পত্তির অধিকার ভোগ না করতে পারে তাহলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে না। নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্যও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। সুশাসনের সঙ্গে শুদ্ধাচারের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক বিদ্যমান। শুদ্ধাচার সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততাকে বোঝায়- যা ব্যক্তির শুদ্ধতা, কর্তব্যনিষ্ঠতা, সততা ও সচ্চরিত্রতা আর সমাজের নীতি- নৈতিকতার মানদন্ডকে নির্দেশ করে। কিন্তু ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই শুদ্ধাচারের অভাবজনিত কারণেও আমাদের বাংলাদেশে সুশাসন প্রলম্বিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রে সুশাসন না থাকলে, সে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থিতিশীল হয় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব উপাদান যেমন, উৎপাদন, বণ্টন, বিনিয়োগ এমনকি ভোগের ক্ষেত্রেও নানারকম বাঁধার সৃষ্টি হয়। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে গিয়ে বাজার ব্যবস্থাও নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। বাজার অর্থনীতিতে সুশাসনের অভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকছে। মুনাফালোভীদের শুদ্ধাচারের অভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুশাসন নয় বরং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সুশাসন অপরিহার্য।
সুশাসনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতির শুরু হচ্ছে 'ক্ষমতা অপব্যবহার' এর মাধ্যমে। আইন ও নীতি নৈতিকতার বিপরীতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটিত হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে সেবা খাতে মোট ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৮৮.৯ কোটি টাকা। এটা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৩.৪ ভাগ এবং জিডিপির ০.৫ ভাগ। ২০১৫ সালের তুলনায় এটি ২১ দশমিক ২ ভাগ বেড়েছে। গবেষণা বলছে, 'যে ৬৯ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন; তাদের ৮৯ শতাংশ বলেছেন, তারা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ তারা যদি ঘুষ না দেন তাহলে সরকারি সেবা পান না।' বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ যদি বিদ্যমান দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে তাহলে আগামী ৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের বেশি অর্জন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে সুশাসন ব্যর্থ হয় জবাবদিহিতার অভাবে। সুশাসনের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাবের জন্য দায়ি কিছু বিষয় আছে। এগুলো হলো প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্বল সংসদ, অনুন্নত রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব এবং দুর্বল নির্বাচনব্যবস্থা। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সংসদে কোনো শক্তিশালী বিরোধীদল ছিল না। এ কারণে সংসদ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারছে না। স্বৈরশাসনও জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে আঘাত হেনেছে। তাছাড়া আমলারা অনেক সময় জনগণের সামনে সঠিক ও সত্য তথ্য প্রচার করতে চায় না। শাসকশ্রেণিরও একটি অংশ তথ্য গোপনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থরক্ষা করতে চায়। এই অস্বচ্ছতা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং সুশাসনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক জবাবদিহিতা যদি দুর্বল হয় তবে তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় খাতকে প্রভাবিত করে।
সামাজিক জবাবদিহিতা হলো নাগরিক, সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং পরিষেবা সরবরাহকারীদের আচরণ ও কার্যকারিতার মধ্যে সুদৃঢ় মিথস্ক্রিয়া। যেখানে সরকার, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা সবাই ন্যায়-নৈতিকতা ও সুশাসনের ভিত্তিতে সম্প্রদায়ের কল্যাণ এবং জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে। সামাজিক জবাবদিহিতা নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সংযোগ সাধন করে থাকে। দেশের রাজনৈতিক নেতারা যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি আন্তরিক না হন, তাহলে সে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয় না। সুশাসনের সাফল্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিকতা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি মেনে চলার ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তথা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সহযোগিতা এবং জনগণের কল্যাণের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নে তাদের নিজেদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমলাতন্ত্রের প্রকোপ ও আইনের শাসন চর্চায় নানাবিধ দুর্বলতা সুশাসনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। দুর্নীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার কারণে মানবাধিকার সংরক্ষণ, ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা, অসাম্যের মাত্রা কমানোর চ্যালেঞ্জগুলো প্রকট হয়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির কারণে আমলাতন্ত্রের মধ্যে 'জনগণের সেবক' অপেক্ষা 'জনগণের প্রভু' সংস্কৃতি বেশি দেখা যায়। এর ফলে, জনগণের সঙ্গে জনগণের প্রতিনিধির দূরত্ব তৈরি হয়- যা বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একটি বড় অন্তরায় হিসেবে বিরাজ করছে। বাংলাদেশে আইন আছে, সংবিধান মৌলিক মানবাধিকারসমূহ স্পষ্টভাবে লিখিত রয়েছে। কিন্তু এসব আইন ও মানবাধিকারসমূহের সুফল সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই আইনের সুফল ভোগ করার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রয়োজন হয়। আইন ও প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক সময় এখানে ব্যক্তি প্রধান হয়ে ওঠে।
প্রশাসনে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করার জন্য এ ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করা জরুরি। দুর্নীতি, অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র, আইনের শাসনে দুর্বলতার মতো সমস্যাগুলো বাংলাদেশের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বিশেষ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই দুর্নীতি প্রতিরোধ, প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা সুনিশ্চিতকরণ, অংশগ্রহণমূলক ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক শুদ্ধাচার সুনিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
অমল বড়ুয়া :প্রাবন্ধিক ও গবেষক