নারী মানেই মা, নারী মানেই একজন পুরুষের প্রেরণা। নারী মানে বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া, নারী মনে অদম্য এক সাহসের নাম। এই নারী নামটাই অনেক ওজনদার- যা আমাদের সমাজের কিছু মানুষের কাছে সহজ কোনো জীব মনে হয়। সত্যি বলতে আমরা নারী মানে কী বুঝি? এ প্রজন্ম, এ দেশের মানুষ, এ বিশ্ব নারীকে কতটা বুঝেছে?
সহজ করে আমাদের এই সমাজ কিংবা দেশ নারীকে কতটা বুঝে সেটাই বলি। খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে এখনো আমাদের সমাজ নারীকে ভোগের দৃষ্টিতেই দেখে। নারী মানে এখনো কামনা-বাসনা পূর্ণতার মাধ্যম ছাড়া এ সমাজ আর কিছুই বুঝে না। বলতে লজ্জা হলেও এটাই বাস্তবতা। তা না হলে এ সমাজে এখনো দৈনিক দু'চারটা করে ধর্ষণ হতো না। আসলে এর চেয়ে বেশি নারীকে নিয়ে ভাবার মানসিকতাই আমাদের ভেতর এখনো তৈরি করতে পারিনি।
এই যেমন খেলার মাঠ থেকে এভারেস্ট, সর্বত্রই বিজয় নিশান উড়াচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। আমাদের এটা নিয়ে তেমন ভাবনা নেই। আমাদের চিন্তাচেতনায় নারীরা আছে আবার নেই। কোন চিন্তায় আছে, আর কোন চিন্তায় নেই সেটাও আমরা জানি।
প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে কর্মসূচি চলছে। নারী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, 'নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ/এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।' নারী দিবসে সব নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। প্রতি বছরই এই দিবসটা এলে আমরা শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা এসবই জানাই। কিছু অনুষ্ঠান, টকশোও হয়। তবে এগুলো ওই দিনটাকে ঘিরে। নারীর প্রতি দিনের পর দিন যে সহিংসতা, নির্যাতন আর বৈষম্য চলছে সেটা নিয়ে আমাদের কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে এ পর্যন্ত কত কি হয়েছে তা বলতে গেলে আমার লেখাটি শেষ হবে না। আমার মনে হয়, পাঠকদেরও এ বিষয়ে বেশ জানা আছে। তবুও আরও একবার জানিয়ে দিই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে একক ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৫৭৩ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণপরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৫ জন। আর এ সময়ে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১২৯ জন। এর মধ্যে ৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণের চেষ্টার কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও ৩ জন।
প্রতিবেদনটিতে আরও জানানো হয়, ২০২৩ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৪২ জন নারী। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। এ ছাড়া এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২২ জন পুরুষ। আর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ খুন হয়েছেন।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অনলাইনেও নারীরা ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছেন। এই মাধ্যমেও বাড়ছে নারীর প্রতি বৈষম্য, অবমাননা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা। শুধু তাই নয়, একই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫০৭ জন নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। গৃহকর্মী নির্যাতন ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় ২০২৩ সালে ৩২ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা যান ৬ জন। এ ছাড়া রহস্যজনক মৃতু্য হয় একজনের। অন্যদিকে, ২০২৩ সালে এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১০ জন নারী।
এত এত কঠিন পরিস্থিতির মাঝেও নারীরা থেমে নেই। হার না মানা অদম্য শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের সর্বশক্তি আর সাহস দিয়ে অর্জন করছে সফলতা। সব জায়গায় পুরুষদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে টিকে থাকছে এবং বিজয়ও ছিনিয়ে আনছে। বর্তমানে কৃষি, সেবা ও শিল্প খাতে কাজ করছেন ২ কোটি নারী। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ষষ্ঠ। সংসদেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা।
জেন্ডার বা লিঙ্গ সমতার বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের ১২ ধাপ উন্নতি হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডবিস্নউইএফ) প্রতি বছর 'গেস্নাবাল জেন্ডার গ্যাপ' নামে এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। ডবিস্নউইএফ গতকাল জেনেভা থেকে ২০২৩ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬ দেশের মধ্যে ৫৯তম। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭১তম। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে গেস্নাবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার চেয়ে ভালো করছে। ২০২৩ সালেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ৫০ বছরে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের মানদন্ডে বাংলাদেশ প্রথম। কেননা, পুরুষের চেয়ে নারী বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে এ পদে আসীন ছিলেন। নারীদের মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তি মানদন্ডও বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সব ক্ষেত্রে নারীরা সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। সচিব, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের জরিপ অনুযায়ী, জিডিপিতে কর্মজীবী নারীদের অবদান ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে ১২ শতাংশ নারী কাজ করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী জানা যায়, কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন তিন গুণ। দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতির মূল কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান ক্রমাগত বাড়ছে। সমীক্ষা অনুসারে, মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। বিবিএসের তথ্য মতে, গত ১০ বছর কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। আর পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা ও তামাক শিল্পসহ অন্যান্য পণ্যের মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫ শতাংশ অর্জনের মূল চালিকাশক্তিই নারী। পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। বাংলাদেশের পুরুষের পাশাপাশি বৈশ্বিক শ্রমবাজারে নারীরাও কাজ করছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি নারী কর্মরত আছেন।
এছাড়াও নারীদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতেও সহায়ক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস থেকে দুই ধাপে ছয় মাস করা, সন্তানের পরিচয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের নাম যুক্ত করা, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে ছেলের পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা নিশ্চিত করা, মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে 'তথ্য আপা' প্রকল্প চালু, নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প, নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প, অতি দরিদ্র ১০ লাখ মহিলার দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া, নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা দেশে বিক্রির জন্য নারীবান্ধব বিপণন নেটওয়ার্ক 'জয়িতা' গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া তৃণমূলের নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী ১২ হাজার ৯৫৬টি পলস্নী মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মা ও শিশুর যত্নসহ যাবতীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ ও সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে।
শত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে নারীরা। নারীদের এগিয়ে যেতে হবেই। সরকারের পাশাপাশি নারীদের সহযোগিতা করতে হবে পুরুষদেরও। আমরা যদি নারীদের প্রতিপক্ষ না ভেবে মানুষ ভাবি তবেই একসঙ্গে কাজ করতে পারব।
মনে রাখতে হবে, দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। জয় হোক নারীর, জয় হোক সাম্যের।
আজহার মাহমুদ :কলাম লেখক