বিশ্বখ্যাত ভাষণের একটি
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আরিফ আনজুম
আজ রক্তঝরা সেই ৭ মার্চের দিন। বিশ্ব নেতারদের মধ্যে যে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মাধ্যমে কত বড় একটি স্থান দখল করে নিয়েছে তা মুখে বলে শেষ করাটা অসম্ভব। বিশ্বের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ বক্তাও বলা চলে বটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কারণ তার সেই ৭ মার্চের ভাষণের তীক্ষণ্নতায় আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। সেই ৭ মার্চের রক্ত টগবগ করার মতো ভাষণে বাংলার দামাল ছেলেরা উজ্জীবিত হয়েই দেশের স্বাধীনতার গুরুত্ব বুঝে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। যার জন্য আমাদের মাতৃভাষা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করাটা অনেকটা পথ সহজলভ্য হয়েছে। এই ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্বের সেরা ৪১টি ভাষণের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে উন্নতির শিখড় হিসেবে। যা যুগ যুগ ধরে এই পৃথিবীতে জীবিত থেকে তার আলো ছড়িয়ে দেবে বাঙালির নামটা উজ্জ্বল করিয়ে।
সংঘাতের মাঝে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। আবার এই ভাষণগুলো ইতিহাসের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। জ্যাকব এফ ফিল্ড তার 'উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেচ' বইটিতে ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ৪১টি ভাষণ সংগ্রহ করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে মাইকেল ও' মারা বুকস লিমিটেড। এই ৪১টি ভাষণের একটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বাঙালি হিসেবে এটি আমাদের গর্বের। রেকর্ড করা এই ভাষণটি আমরা বহুবার শুনেছি। বারবার আমরা শুনি। ভাষণটির আবেগ আর আবেদন আমাদের মনকে আবেগাপস্নুত করে দেয় বারবার। আর ৪০টি ভাষণ সম্বন্ধে আমাদের জানা উচিত এই জন্য যে, এই ভাষণগুলো আমাদের সাহায্য করবে মনে করে দিতে ইতিহাসের ৪০ জন শ্রেষ্ঠ মানুষের কথা। এদের একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণগুলো আমাদের সাহায্য করবে মনে করে দিতে ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনার কথা। বাক্য আর শব্দ যে কত শক্তিশালী হতে পারে তা আমরা বুঝতে পারব। এসব ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই সংগ্রাম যেসব সময় বিজয় কেড়ে এনেছে তা নয়, তবে মানুষের স্মৃতি ভান্ডারে গচ্ছিত থেকেছে দীর্ঘকাল ধরে। যা পরে ইতিহাসের দিক নির্ণয়ক হয়েছে। সংগৃহীত এই ভাষণগুলোর প্রথমটি দিয়েছিলেন গ্রিসের সমর নায়ক পেরিক্লিস। তিনি ক্ষমতায় আসেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬১ সালে। তখন গ্রিস কয়েকটি নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল অ্যাথেন্স ও স্পার্টা। অ্যাথেন্স আর স্পার্টা যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকত। অ্যাথেন্সের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পেরিক্লিস এই ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি জনগণকে বলেছিলেন, অ্যাথেন্সের সৌন্দর্য দু'চোখ দিয়ে উপভোগ করতে থাকুন। যখন তার গৌরব গাথা আপনার মন ভরিয়ে দেবে তখন মনে করুন সেসব বীরদের কথা, যারা অসীম সাহসের সঙ্গে এই দেশ সৃষ্টি করেছিলেন। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার গ্রিস থেকে যাত্রা শুরু করে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে ভারতের পূর্ব প্রান্তে পৌঁছান। পূর্ব ভারত জয় করার পর তিনি আরও পূর্বদিকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সেনা নায়করা অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি তাদের রাজি করানোর জন্য একটি আবেগময় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আমরা তো মেসিডোনিয়াতে নিজের বাড়ি পাহারা দিয়ে আরামে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমাদের আকাঙ্ক্ষা আমাদের এত দূরে নিয়ে এসেছে। চলুন আমরা আমাদের বিজয়ের সঙ্গে আর একটু যোগ করি। যারা ফিরে যেতে চান তারা ফিরে যেতে পারেন। আর যারা থাকতে চান তারা আমার সঙ্গে থাকতে পারেন। তবে যারা থেকে যাবেন তারা ফিরে যাওয়া মানুষের ঈর্ষার পাত্র হবেন। ক্লান্ত আর দেশে ফেরার জন্য উন্মুক্ত সেনা নায়কদের আলেকজান্ডার আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
একাদশ শতাব্দীতে বাইজান্তাইন সম্রাট তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না। এদিকে তার অর্থের ভান্ডার প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছায়। তিনি পোপ দ্বিতীয় আরবানের কাছে সাহায্য চেয়ে দূত পাঠান। ধর্মযুদ্ধে যোগদানের জন্য পোপ খ্রিষ্টানদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই যুদ্ধে যাওয়ার সময় বা এই যুদ্ধে যারা প্রাণ হারাবেন তাদের সব পাপ গড মাফ করে দেবেন। এরপর শুরু হয় মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই- যা ইতিহাসে ক্রুসেড নামে পরিচিত। ক্রুসেডে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন সুলতান সালাহউদ্দিন। ১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ৯১ বছর ধরে বিধর্মীরা জেরুজালেম দখল করে আছে। এতদিন আমরা আলস্নাহর কাছে ইবাদত করতে পারিনি। এবার সুযোগ এসেছে, আলস্নাহর ইচ্ছায় আমরা জেরুজালেম উদ্ধার করতে পারি। মুসলমানরা এই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রুসেডে যোগ দেয়। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন জর্জ ওয়াশিংটন। এক পর্যায়ে আমেরিকার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। অর্থের অভাবে সৈন্যদের বেতন দেয়া যাচ্ছিল না। জর্জ ওয়াশিংটন সৈন্যদের কথা দেন যে, তিনি সব বকেয়া টাকা দিয়ে দেবেন। সৈন্যরা তবু সন্তুষ্ট হয়নি, সেনা বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সৈন্যদের উদ্দেশে ১৭৮৩ সালের ১৫ মার্চ তিনি একটি হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের কথা দিয়েছি, সে কথা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। কিন্তু তোমরা এমন কিছু করো না যাতে তোমাদের সৃষ্টি করা গৌরব নিন্দায় পরিণত হয়।
আমেরিকায় ১৮৬১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথাকে কেন্দ্র করে। ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ যুদ্ধে দাস প্রথার পক্ষের দক্ষিণাঞ্চল পরাজিত হয়। ১৮৬৪ সালে পুননির্বাচিত হলে তার সামনে আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। আর তা হলো গৃহযুদ্ধের পারস্পরিক বিদ্বেষ ভুলে জাতিকে একত্রিত করা। এই পটভূমিকায় ১৮৬৫ সালের ৪ মার্চ তিনি উদ্বোধনী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়; বরং সবার প্রতি প্রীতির হাত বাড়িয়ে আসুন আমরা আমাদের কাজ শেষ করি। যারা আহত হয়েছেন, যুদ্ধের কারণে হওয়া বিধবা আর এতিমদের সঙ্গে নিয়ে আসুন, আমরা স্থায়ী শান্তির জন্য কাজ করি।
\হলেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আত্মরক্ষার জন্য সরকার একটি সামরিক বাহিনী গঠন করে, যার নাম দেয়া হয় 'লাল ফৌজ'। এদিকে তাদের বিরোধীরা ভূ-স্বামী, শিল্পপতি ও কয়েকটি বিদেশি সরকারের সাহায্যে গঠন করে 'সাদা বাহিনী'। সাদা বাহিনী রাশিয়াকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে নবগঠিত সরকারের বিরুদ্ধে। এমনি পটভূমিকায় ১৯১৯ সালের ২৯ মার্চ লাল ফৌজের উদ্দেশে ভাষণ দেন লেনিন। তিনি বলেন, ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষ আর কৃষকরা ভূ-স্বামী আর পুঁজিপতিদের উৎখাত করেছে। এজন্য বিদেশি শক্তি প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু তারা সক্ষম হবে না। আপনারা একতাবদ্ধ থাকুন, একনিষ্ঠ থাকুন, শক্ত থাকুন। সাহসের সঙ্গে শত্রম্নর মোকাবিলা করুন। জয় আমাদের হবেই। ভূ-স্বামী আর পুঁজিপতিদের শক্তিকে রাশিয়াতে ধ্বংস করা হয়েছে। এটা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে।
চীনের বিপক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাও সে তুং। ১৯৪৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক ভাষণে তিনি বলেন, বিপদের সময় আমরা যেন আমাদের অর্জনকে ভুলে না যাই। আমরা যেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবী আর সাহস সঞ্চয় করি। চীনের মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে, তাদের জন্য আমরা যেন সংগ্রাম করি। যেখানে সংগ্রাম সেখানেই মৃতু্য। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে রয়েছে মানুষের জন্য মঙ্গল কামনা। তাদের জন্য মৃতু্যবরণ করা গৌরবের। কিন্তু আমরা যেন অপ্রয়োজনীয় মৃতু্যবরণ না করি। আমাদের কর্মীদের যেন থাকে সহকর্মীদের জন্য সহমর্মিতা এবং তারা যেন একে অপরকে ভালোবাসে এবং পরস্পরকে সাহায্য করে।
চিলির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি স্যালেভদর আলেন্দেকে আক্রমণ করে সে দেশের সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে রেডিও মারফত জাতির উদ্দেশে তিনি একটি ভাষণ দেন। মনুষ্যত্বের কী মহৎ প্রকাশ! তিনি বলেন, আপনাদের কিছু বলার এটাই আমার শেষ সুযোগ। বিমান বাহিনী রেডিওর অ্যান্টেনাতে বোমা মারছে। আমি আপনাদের জানাচ্ছি, আমি পদত্যাগ করব না। জনগণের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য আমি আত্মত্যাগ করব। তাদের শক্তি রয়েছে এবং কিছু দিনের জন্য তারা হয়তো আমাদের ওপর খবরদারি করতে পারে কিন্তু সামাজিক প্রক্রিয়াকে অপরাধ বা শক্তি দিয়ে থামিয়ে রাখা যায় না। ইতিহাস আমাদের পক্ষে এবং জনগণ ইতিহাস সৃষ্টি করে।
বিশ্বের অন্য ভাষণগুলোও মহৎ ব্যক্তিদের দেয়া মহতী ভাষণ ঠিক আমাদের দেশ নায়ক দেশস্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই দেশ মাতৃকার অমৃত রসপ্রাণ করার ধ্বনিতে উচ্চারিত হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসের ৪১টি শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি। এটি আমাদের সবার জন্য অহংকারের। জাতির চরম বিপদের দিনে তিনি আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার সেই আদর্শিক নির্দেশনা আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। এই বাঙালির বাংলা আর এই বাংলা ভাষার আয়ুষ্কাল যতদিন থাকবে বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণের ইতিহাস ততদিন উজ্জীবিত থাকবে।
আরিফ আনজুম : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক