'তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে শাশ্বত এক মহাকাব্যমোর প্রাণে/এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে/, 'রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত এই সঙ্গীতের মতো ৭ মার্চের ভাষণ কবিতার মতো, বাংলার লোক সঙ্গীতের মতো পঞ্চান্ন হাজার একশত ছাব্বিশ বর্গমাইলের পূর্ববাংলায় ব্যাখ্যাতীত এক দেশ প্রেমের চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিল, বিশ্বে এটি ছিল অদৃশ্যপূর্ব। এর পরিপ্রেক্ষিত, পটভূমি শুরু হয়েছিল কোন শতক, কোন দশক থেকে তার দিনক্ষণ বলা না গেলেও একটি কথা আমরা বলতে পারি, এ' বক্তৃতার মূলবাণী কিন্তু অলক্ষ্যে লেখা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে যেদিন ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ছাত্র জনতার সঙ্গে রাজপথে নেমেছিলেন শেখ মুজিব। ভাষার লড়াইয়ে শেখ মুজিবের অংশগ্রহণ এবং ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সে লড়াই সংঘটিত করতে গিয়ে তাকে যে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো, সেদিন কারাগার থেকে পাকিস্তানের কাঠামোর বাইরের স্বতন্ত্র কাঠামোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করল বাঙালি। শুরু হলো বাঙালির স্বতন্ত্র আবাস, স্বাধিকারের লড়াই। অদৃশ্যে পাকিস্তানের পথ বেঁকে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পথের দিকে এগোতে থাকল। তখনো এই এগোনো ছিল স্বপ্ন। এই স্বপ্ন যাত্রা পথের সঙ্গী, নেতা, বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের মহাকবি শেখমুজিবুর রহামান। এই স্বপ্ন পথ এসে যেদিন রেসকোর্সে লক্ষ বাঙালির মহামিলনে মিশে গেল সেদিন প্রকৃত পক্ষে রচনা শুরু হলো মহাকাব্যের। আটচলিস্নশ সালে দিনক্ষণ নির্ধারণ করে রাখা হয়নি, অপেক্ষায় ছিলেন কবি মহাজাগরণের। মুক্তির জন্য জাতীয় চেতনা যখন দুনির্বার তখন জাতির আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দিনক্ষণ ঠিক করা হলো এবং তা' নির্ধারণ করল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, পেশার মানুষ সেদিন রেসকোর্সে উপস্থিত হয়নি, কোনো বিশেষ মতের মানুষ আকশে স্স্নোগানের ঢেউ তুলেনি, সাড়ে সাত কোটি মানুষ সেদিন প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে উপস্থিত ছিল রেসকোর্সে। ইতিহাস সেদিনটির জন্য অপেক্ষায় ছিল অনাদিকাল থেকে।
বাঙালির মাতৃ ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছিল সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। সংস্কৃতি কেন্দ্রিক এ' ভালোবাসা বাঙালিকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে নিজেদের ভাষার ব্যবহার এবং এর সমৃদ্ধি সাধনের জন্য। মধ্যযুগ থেকে ১৯৪৭ এর পূর্ব পর্যন্ত সময়ে স্বজাতির জন্য ভূখন্ড প্রতিষ্ঠা করার সুনির্দিষ্ট চিন্তার কোনো প্রতফলন আমরা দেখতে পাইনা। সাতচলিস্নশ পরবর্তী সময়ে ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে যখন রাজনৈতিক উপাদান যুক্ত হলো তখন ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে বাঙালি তার আত্মাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করল। ভাষার সমৃদ্ধির জন্য বাঙালির সচেতনতার সাথে সাতচলিস্নশ পরবর্তী সময়ে যখন রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি যুক্ত হলো তখনই ভাষা কেন্দ্রিক ভাবাবেগের মোড় ঘুরে গেল। অধিকার আদায়ের আন্দোলন তখন অনেকটা দৃশ্যমান হলো। সাতচলিস্নশের ১১ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুসহ আরও কিছু ছাত্রনেতা জীবনকে বাজি রেখে পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে গেলেন সেদিন থেকে প্রকৃত পক্ষে নুতন মহাকাব্যের পান্ডুলিপি লেখা শুরু হলো। সে পান্ডুলিপিতে মা, মাতৃভূমি, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার সংস্কৃতি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হলো। সেই রূপান্তরে প্রক্রিয়ায় সামিল হলেন বাঙালির রাজনীতির মহাকবি, দূরদর্শীরা তখন ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণকে আমরা বক্তৃতা, কবিতা কিংবা সঙ্গীত যাই বলিনা কেনো এই বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিত ছিল অনন্য। এ বক্তৃতা তুলনা করা হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পিটস, মার্টিন লুথার কিং-এর ভাষণের সঙ্গে। আর অহরহ তুলনা করা হয় আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেসের সঙ্গে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরে যখন জেনারেল লি আত্মসমর্পণ করেছেন এবং ইউনিয়ন আর্মির প্রধান জেনারেল গ্রান্ট বিজয়ী ও বিজিত উভয় বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছেন, তার চার মাস পর আব্রাহাম লিঙ্কন গ্যাটিসবার্গে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য সব মার্কিন জনসাধারণের কাছে একটি মানবিক আবেদন রেখেছিলেন এবং তিনি যখন এ ভাষণটি দিয়েছিলেন, তখন গ্যাটিসবার্গ ও তার আশপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেসকোর্সে ভাষণ দেওয়াটা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জনগণের শত্রম্নর ঘাঁটির মধ্যে বসে শত্রম্নর বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার ঘোষণা দিলেন। কারণ, রেসকোর্স ময়দান থেকে ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাথর ছোড়ার দূরত্বে। কী ভয়াবহ অবস্থা ভারসাম্যহীন কিছু বললেই লাখো বাঙালিকে পাকিস্তানিরা নিঃশেষ করে দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। নিপুণ কৌশলে শত্রম্নর বিরুদ্ধে জনগণকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন যা বাঙালিদের বুঝতে মোটেই কষ্ট হয়নি। মার্টিন লুথার কিং যেমন বর্ণবাদমুক্ত ও বৈষম্যহীন একটি জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য জাতিকে জাগ্রত হতে বলেছিলেন; বঙ্গবন্ধুও তার ৭ মার্চ ভাষণে ঠিক তেমনই বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতিকে সংগ্রাম করতে বলেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন তার ভাষণের দ্বারা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন; বঙ্গবন্ধুও ৭ মার্চের সেই অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণের দ্বারা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও মার্টিন লুথার কিং-এর স্বপ্ন ছিল একই সূত্রে গাঁথা।
১৯৭১ সালের এপ্রিলে নিউজ উইক ম্যাগাজিন ওদের একটি কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে 'পোয়েট অব পলিটিক্স' বলে আখ্যায়িত করে। রাজনীতির কবি। বাঙালি চরিত্রের সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে যিনি বিশ্বমানব হতে পেরেছিলেন। মহা নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যিনি হয়ে উঠেছিলেন খাঁটি সোনা, তিনি শেখ মুজিব, মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু। তিনি মহাজাগরণ তৈরি করতে পেরেছিলেন। জাগরণ শুধু তৈরি করেননি এই জাগরণের অবিচ্ছদ্য অংশও ছিলেন তিনি। জনগণ প্রস্তুত হওয়ার পর তিনি তাঁর তেজোদীপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেন -'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। রেসকোর্সের ময়াদানে তখন পাকিস্তান বাহিনীর হেলিকাপ্টার ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আবেগ, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ কিন্তু সজ্ঞানে তিনি শিষ্টাচার, কূটনীতির নিয়ম লঙ্ঘন করেননি। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর নির্বাচন, '৫৮-এর সামরিক শাসন, '৬৬-এর ছয় দফা, '৬৯-এর গণ-অভু্যত্থান, '৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের বঞ্চনার কথা তিনি যেমন জানিয়েছেন; অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা এ বক্তৃতার সারমর্ম বুঝতে পারেনি সম্পূর্ণভাবে।
একজন নেতার একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ একটি জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ ও আমরণ সংগ্রামে উদ্বেলিত করতে পারে, তার অনন্য নজির হয়ে আছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে। এই ভাষণের শক্তিকে ধারণ করেই কিন্তু বাঙালিরা উজ্জীবিত হয়েছিল দেশকে স্বাধীন করার চেতনায়। যার ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে একবারের জন্যও পিছু তাকায়নি। আর তাদের ত্যাগের ফলাফল আজকের বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যদি আমরা সাহিত্য সমালোচনার দৃষ্টিতে বিচার করি, তাহলে সহজেই এর মহাকাব্যিক আঙ্গিক উপলব্ধি করতে পারি। মহাকবিরা সাধারণত কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তার লেখার উপজীব্য বা বিষয়বস্তু হিসাবে নির্ধারণ করেন, যার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট জাতির ইতিহাস, যা পাঠ করে মানুষ আন্দোলিত হয়, অনুপ্রাণিত হয় এবং কোনো মহৎ কর্মে দীক্ষিত হয়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু কয়েক মিনিটের একটি অলিখিত ভাষণ সেটিরই প্রতিরূপ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি মহাকাব্যিক আবেদন মহাকাল বিচার করবে। লাখো জনতার সামনে একটি অনুপম কবিতার মতো, স্ফুলিঙ্গের মতো ও সাগরের উত্তাল জলরাশির মতো সত্য সুন্দর শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু।
এ ভাষণের ব্যঞ্জনা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব সেদিন যারা কাছে বসে শুনেছেন, তারাই বুঝতে পারবেন। সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক করতে এ ভাষণের কোনো বিকল্প ছিল না।
তিনি যথার্থই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা- 'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না' সত্য হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এ ভাষণের সুর অনুসরণ করেই এক নতুন রেনেসাঁর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল।
কিছু কিছু বক্তব্য, সৃষ্টিকর্ম, মহৎ বাণীর দেশকাল থাকে, থাকে প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতার সীমাবদ্ধতা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটির আবেদন চিরকালীন, পৃথিবীর যতো সীমান্ত আছে সব সীমান্তকে অতিক্রম করার মতো যোগ্যতা আছে ভাষণটির। এ বিষয়টি উপলব্ধি করে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্ব পূর্ণ প্রামান্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেবার আছে অনেক কিছু ভাষণটির বহিরাঙ্গের সৌন্দর্যে শুধু মুগ্ধ না হয়ে এর ভেতরের বাণীকে ধারণ করতে হবে, এর ভেতরে রয়েছে অনেক বার্তার মধ্যে অন্যতম বার্তা হলো ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশকে স্পর্শ করতে হলে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মর্মমূলে।
শেখর ভট্টাচার্য : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক