সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে- যার মধ্যে অন্যতম ছিল গত ২৯ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৪ (বৃহস্পতিবার) বেইলি রোডে অবস্থিত বহুতল ভবনের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা। যা কেড়ে নিয়েছে হাজারো মানুষের স্বপ্ন। জন্ম দিয়েছে আবেগ। আগুনের কাজই হলো সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করে দেওয়া। সে কখনো মানুষের বন্ধু হতে পারে না। আগুন সুযোগ পেলেই ধূলিসাৎ ও ছাই করে দেয় মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে। আমরা উদাসীন জাতি আগুনের বিধ্বংসী দৃশ্য দেখেও নিরাপদ থাকতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করি না। আগুনকে কোলে নিয়েই ঘুমাই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আগুন কি তার সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে? নাকি আমরা আগুনকে সুযোগ করে দিচ্ছি?
বিগত কয়েক বছরে নিমতলী, সাভারের আশুলিয়া, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলী অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন মারা যায়। এর পরের বছর সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১১১ জন মারা যায়। বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিরাট ক্ষতির শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের। এমন অগ্নিকান্ডের ঘটনা হাজারো মানুষের স্বপ্নকে পুড়িয়ে শোকে পাথর হওয়ার গল্প তৈরি করে। সৃষ্টি করে, অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে সারাদেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ অনুমান করা যায়। যেমন- অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, জরুরি নির্গমনের বিষয়ে জ্ঞান না থাকা, দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থের অনুমোদনহীন গুদামজাতকরণ, রান্না ঘর থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুন ও সিগারেটের লাভা থেকে ছড়িয়ে পড়া অগ্নি। গত বছর বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৯ হাজার ৮১৩ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যা ছিল মোট আগুন লাগার ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ৪ হাজার ৯০৬টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যা ছিল মোট আগুনের ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চুলা থেকে গত বছর ৪ হাজার ১১৭টি অগ্নির ঘটনা ঘটেছে। যা ছিল মোট আগুন লাগার ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ। এছাড়া ছোট বাচ্চাদের আগুন নিয়ে খেলা করার সময় ৯২৩টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ১২৫টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে- যা ছিল মোট আগুন লাগার ০ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এই পর্যন্ত বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৪৬ জন মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ১২ জন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে সংকটজনক অবস্থায় আহাজারি করছে। গ্রিন কটেজ নামক সাত তলা ভবনে ৮টি রেস্টুরেন্টে ছিল। যার জন্য শুধু ব্যবহার করার একটি লিপ্ট ছিল। ছোট একটি নামা-ওঠার জন্য সিঁড়ি থাকলেও তা ভরপুর ছিল গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে। আগুন লাগার মূল কারণ ধারণা করা হচ্ছে, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়া- যা কার্বন মনোক্সাইড ধোঁয়া সৃষ্টি করেছে। সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসকের মতে- মারা যাওয়া ৪৬ জনের বেশিরভাগ শরীরে পোড়া কোন দাগ ছিল না। এক্ষেত্রে মৃতু্যর কারণ কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং সহজ ভাষায় যাকে বলে বিষাক্ত কার্বনের ধোঁয়া।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলেছে, ভবনটিতে ব্যবসা করার অনুমতি ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের মতে- তাদের তিনবার জরুরি নোটিশ পাঠালে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিস পরবর্তী সময়ে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সুতরাং, অগ্নিকান্ডের দায় ফায়ার সার্ভিস কোনো মতেই এড়াতে পারে না। ভবন কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের নোটিশ গায়ে মাখেনি। তাই গাফেলতির চিত্র ফুটে উঠেছে।
আমরা জাতি হিসেবে বিবেকহীন হলেও আবেগ সব সময় চরম পর্যায়ে থাকে। পরম সত্য হলো, আমাদের আবেগটা যেন বৃত্তের মতো চক্রাকার কেন্দ্রিকও বটে। অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে, আবেগের জন্ম হয়। নতুন আরেকটি ঘটনা ঘটে, পুরাতন ঘটনার জন্য আবেগ সরে যায়। দিন শেষে আমরা ঘটনার কারণ খুঁজে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করি না। ফলপ্রসূতে প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে অগ্নিকান্ডের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয় স্বজন হারানোর আহাজারি ও রোনাজারির।
সরকার থেকে যথেষ্ট অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবস্থা নিলেও মানুষের অসচেতনতায় অগ্নিকান্ডের পেছনে মূল কারণ হিসেবে দাঁড়ায়। ভবন নির্মাণের সময় সাবধানতা অবলম্বন করা হয় না, জরুরি নির্গমনের ব্যবস্থা থাকে না। রাজউকের ভবন নির্মাণের সময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদারকির ঘাটতি থাকা যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মানুষের জবাবদিহি যখন থাকে না তখন মানুষ আর মানুষের কাতারে থাকে না। সে হয়ে যায় পশুর চেয়েও জঘন্য। জবাবদিহিতা পারে সুন্দর নিয়মানুবর্তিতার পরিবেশ তৈরি করতে। জবাবদিহিতা থাকলে গাড়ির ড্রাইভার সিটবেল বাঁধে, বাইকার হেলমেট পরে, রাস্তায় বেশি জোরে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকে ও নিয়ম মানতে বাধ্য হয়।
মানুষ বুক ভরা স্বপ্ন ও আশা নিয়ে বাড়ি ছাড়ে। ব্যস্ত নগরীর বুকে স্বপ্ন বুনতে হাজির হয়। এই স্বপ্ন হতে পারে পরিবারের হাল ধরবে বলে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে। কিন্তু সবাই কি স্বপ্ন পূরণ করতে পারে? কেউ লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। কেউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
তাদের আর বাড়ি ফেরা হয় না। বাবা মায়ের আশা পূরণ করা হয় না। তাহলে প্রশ্ন, এই শহর কি নিরাপদ নয়? যদি তা না হয়, তাহলে কেন আমরা সতর্ক হই না? আমাদের সতর্ক হওয়া বৈ বিকল্প কোনো উপায় নেই। অবিলম্বে এ ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা রোধে সরকারি নীতিমালা, কঠোর নজরদারি ও তার প্রয়োগ প্রয়োজন। অন্যথায় এই ধরনের প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটতে থাকবে।
রাসেল হোসেন সাকিব : কলাম লেখক