বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। ঢাকার পর চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব আয়ের অন্যতম অঞ্চল হিসেবে দেখা হয়। এখানে বাংলাদেশের প্রধান বন্দর রয়েছে। প্রতিদিন শত শত মালবাহী গাড়ি বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে পাড়ি জমান, চট্টগ্রামের উৎপাদিত নানা পণ্য সামগ্রী দেশ-বিদেশে রপ্তানি হয়। দুনিয়ার নানা প্রান্ত হতে চট্টগ্রাম বন্দরে হাজার ধরনের পণ্য আসা-যাওয়া হয়। চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট সর্বদা ব্যস্ত থাকে। পণ্যবাহী গাড়িতে রোডঘাট ব্যস্ত সময় পার করে। সব ধরনের ব্যবসার অসংখ্য অফিস চট্টগ্রামে রয়েছে। বাংলাদেশের সব জেলার মানুষ এবং বিদেশি নাগরিকদেরও এখানে অবস্থান আছে। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতীর অংশীদার চট্টগ্রাম। ইপিজেড, কেপিজেডসহ চট্টগ্রাম জুড়েই আছে নানা ধরনের শত শত শিল্পকারখানা। অর্থনীতির অন্যতম উৎপাদন ঘাটি চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম যেভাবে দেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্য অবদান রাখছে, তার তুলনায় চট্টগ্রামের জনগণ নানাভাবে রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে বঞ্চিত। অনেক সেবা প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে হস্তান্তর করা হয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণের জন্য গড়ে তোলা পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পটি এখনো পর্যন্ত বন্ধ। সেখানে মাদকসেবীদের আড্ডার আসর বসে। অবৈধ বসবাসকারীদের দখলে ক্যাম্পটি পড়ে আছে। এক শ্রেণির সরকারি কর্মচারি নানাভাবে ফায়দা গ্রহণ করছে। ইতিপূর্বে অনেক লেখকই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট হাজী ক্যাম্পের প্রয়োজনীয়তার কথা উলেস্নখ করে লিখেছেন। ওই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি। স্থানীয় মান্যগণ্য ধর্মপরায়ণ জনগণ আমার জানা মতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আবেদন নিবেদন করেছেন। তবুও কোনো আশার সুসংবাদ বলার মতো নেই বলা চলে। চট্টগ্রাম নামে বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও বাস্তবিকই চট্টগ্রামের জনগণের নানাদিকে সেবা পেতে ভোগান্তির শেষ নেই।
চট্টগ্রাম সিটি এলাকায় প্রায় আশি লাখের অধিক জনগণের বসবাস। অসংখ্য রাস্তাঘাট রয়েছে। সঙ্গে বিপুল সংখ্যক নালা-নর্দমা আছে। মুরাদপুর, বহদ্দার হাট ইপিজেট একে খান সিটি গেইট, বড়পোল আশপাশের বিভিন্ন নালা-নর্দমা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। সেই নালার ময়লাগুলো রাস্তার ওপরে জমাট করে রাখতে দেখা যাচ্ছে। সেই নালার ময়লা পুনরায় বৃষ্টি ও ধুলাবালির সঙ্গে মিশিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। রাস্তার ওপর বাজার, হকার মার্কেট তাদের ময়লাগুলো রাস্তার যত্রতত্র ফেলছে। রাস্তার মধ্যে দোকান-বাজার মনে হয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রশাসন কেউ দেখেও দেখছে না। অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্নভাবে নগরীর উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম ৪১টি ওয়ার্ডের সবখানে ময়লা আবর্জনা অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্নতায় ভরপুর। বাসাবাড়ির সমস্ত ময়লা আবর্জনা উচ্ছিষ্ট নালা ও রাস্তার মধ্যে নিত্যদিন ফেলছি। এসব ময়লা নালা জ্যাম করছে। আর পলিথিন, উচ্ছিষ্ট পানির বোতল, নানা জাতের পস্নাস্টিক সামগ্রিক কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। নদীর নাব্যতা পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে।
ফলে এসব অপরাধকে কঠোরভাবে পরিবেশ আইন, সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম মতে নিয়ন্ত্রণ করা চাই। বর্ষার পূর্বে নালার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে পানি চলাচলের জন্য এখন থেকে নালাগুলো তৈরি করা হোক। ফুটপাত ও রাস্তা থেকে হকার ও বাজার সরিয়ে ফেলা হোক। তাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ব্যবহার উপযোগী জায়গা তৈরি করা হোক। আরও বেশ কিছু এলাকার নালা সংস্কার ও পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। নগরীর অসংখ্য নালা ময়লা ভর্তি দেখতে পাওয়া যায়। শহারের বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনার ভাগাড় রাস্তার মোরে মোরে ও নানা ড্রেনের পাশে পড়ে থাকতে চোখে পড়ে। অলংকার, সাগরিকা মোড়, আগ্রাবাদ চোট পুল, বহদ্দার হাট, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নতুন চাঁদগাও থানা। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে দিনের পর দিন বাসাবাড়ির উচ্ছিষ্ট ময়লা আবর্জনার স্তূপ জমে থাকতে দেখা যায়। দিনের বেলায় ময়লার গাড়ির খোলা ট্রাকের দুর্গন্ধে রাস্তায় জনচলাচল মারাত্মকভাবে হুমকিতে পড়ে। মানুষ নাকেমুখে রুমাল দিয়েও দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয় না। বলা যায়, পুরো শহরেই যত্রতত্র ময়লার স্তূপ দিনের পর দিন জমে থাকে।
বাসাবাড়ি, দোকান, অফিস পাড়ার ময়লা আবর্জনার সরাসরি নালা ড্রেনে ফেলছে। রাস্তা পরিষ্কার করে সেই আবর্জনা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নালায় ফেলতে মোটেও চিন্তা করে না। চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দার হাট, মুরাদপুর, ষোলশহর ২নং গেইটে উত্তর পার্শ্বে নালার সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ অনেক দিন থেকেই দেখছি। কাজের কর্মসূচি চলমান আছে। ধীরগতিতে কাজের কারণে ওই এলাকার ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষতি ও ভোগান্তি হচ্ছে। মুরাদপুর হতে বহদ্দার হাট পর্যন্ত বিশ্ব রোডের দক্ষিণ পার্শ্বে অনেকগুলো কাঠের দোকানের ব্যবসা। এন মোহাম্মদ অফিস থেকে রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে সারি সারি কাঠের দোকান। তারা দীর্ঘদিন থেকে এখানকার কাঠ ব্যবসায়ী। তাদের বড় বড় কাটা গাছ, সাইজ করা কাঠ দোকান থেকে ফুটপাত দখল করে রাস্তা পর্যন্ত এসে গেছে। ওই দিকের বড় বড় ড্রেনের ওপর কোনো স্স্নেভ রাখা হয়নি। নালা আছে, কিন্তু নালার ওপর জনচলাচলের ব্যবস্থা নেই। সেই ব্যবসায়ীরা তাদের কাঠ দিয়ে নালার ওপর দোকান বসিয়ে কাঠব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বহদ্দার হাট পুলিশ বিট পর্যন্ত কাঠব্যবসায়ীদের দখলে নালা ও ফুটপাত দেখা যায়। প্রতিদিন স্থানীয় এবং চট্টগ্রামের নানা অঞ্চলের যাতায়াতকারী জনগণ ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। দেখা যায়, এসব ব্যবসায়ীরা কাঠের সমস্ত উচ্ছিষ্ট প্রতিনিয়ত নালাতেই ফেলছে। এটি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে বর্ষার সময় সে এলাকায় বৃষ্টির পানি নালায় ধারণ করা সম্ভব হয় না। নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত হয় না। অসংখ্য ময়লা আবর্জনায় ওই অঞ্চলের ড্রেন ভরপুর। স্থানীয় এলাকার কমিশনার নিশ্চয় এই বিষয়টি অবগত আছেন। কিন্তু তবুও তার কোনো প্রতিকার বা সংশোধন জনগণ দেখছে না। এসব কারণে মুরাদপুর, বহদ্দার হাট এলাকায় বৃষ্টির সময় জনভোগান্তির কথা জনগণ বলছে। অভিযোগ শুনা যায়, স্থানীয় কমিশনার দেখেও না দেখার মতো করে চলছে। ফলে এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার প্রভাব থেকে জনগণ মুক্তি পাচ্ছে না। সচেতন স্থানীয় নাগরিক সিটি কর্পোরেশনকে এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে নালাকে অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা সিটি মেয়র উপরোক্ত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে চট্টগ্রামের নালা ড্রেনগুলো দখলমুক্ত করবে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে বর্ষা মৌসুমে নালার পানি চলাচলে জনভোগান্তি লাঘবে সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। নালার ওপর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। উন্মুক্ত নালাগুলোকে জনচলাচলের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে।
নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডেই প্রায় ফুটপাত হকারের দখল। ইতিমধ্যে শহরের কিছু কিছু স্পটে হকারদের উচ্ছেদ করলেও পুনরায় তারা ফুটপাত দখল করছে। তাদের জন্য নির্দিষ্টভাবে বসার জায়গা করা যেতে পারে। রুজি রোজগারের জন্য চিন্তা করা দরকার। অন্যথায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে। নগরবাসী জীবন জীবিকার জন্য ফুটপাত ব্যবহার করতে পারছে না। অনেক সময় জনগণ হকারদের তোপের মুখে পড়ে। প্রতিবাদ করলেই ঝগড়া লেগে যায়। কোনো কোনো হকার স্থানীয় কমিশনার এবং রাজনৈতিক নেতাদের নাম ব্যবহার করে তাদেরকে চাঁদা দেওয়ার কথা বলে। বিভিন্ন সময় সিটি কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট অভিযানে ফুটপাত থেকে হকারদের সরাতে দেখা যায়। কিন্তু পরক্ষণেই আবার একই চিত্র শুরু হয়। হকাররা ফুটপাত দখল করে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। তাদের ব্যবসার জন্য মোটেও নগরবাসীর কোনো অভিযোগ নেই। তারা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করুক সেখানে জনগণের কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি হলো জনচলাচলের ফুটপাত যেন সবসময় উন্মুক্ত থাকে। সে দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনকে জনস্বার্থে পালন করতে হবে। নালার ওপর সবধরনের ব্যবসায়িক দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করতে হবে। নালাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নগরবাসীকে সর্বদা আপনাপনভাবে সচেতন করার প্রয়োজনীয় কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। নালার ওপর অবৈধ আবর্জনা যারা ফেলছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ চায় সচেতন জনগণ। প্রয়োজনে সিটি কর্পোরেশন আইনে জরিমানার বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। শহর আমার দায়িত্ব আমাদের একা সিটি কর্পোরেশনের ওপর অথবা সেবা সংস্থাকে দোষারোপ করলে চলবে না। নগরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে নগরবাসীর দায়িত্বের পাশাপাশি তাদের ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা ও সংরক্ষণ স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রাখতে হবে।
নগরীর সবগুলো সেবা সংস্থাকে সমন্বয় ও পরিবেশবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের সেবা কার্যক্রম চালানো দরকার। বর্ষার পূর্বেই সবগুলো নালা যেন পরিচ্ছন্নতার আওতায় আনা হয়। মশার যন্ত্রণায় পুরো নগরবাসী অতিষ্ঠ। মশা নিধনে কার্যকর মশার ওষুধ পুরো সিটি কর্পোরেশন এলাকায় একযোগে ব্যবহার করা হোক।
মাহমুদুল হক আনসারী : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট