বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

জনজীবনে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব

রাসেল হোসেন সাকিব, ঢাকা
  ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
জনজীবনে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব

অর্থনীতির অন্যতম বিষফোড়া হলো মূল্যস্ফীতি, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। অর্থনীতির সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ বর্তমানে মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির কবলে রয়েছে। যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। চলমান মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পণ্যের দাম ৯ শতাংশ হারে বাড়ল এবং একই পরিমাণ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেল। ফলস্বরূপ আগের একই সমান টাকা দিয়ে বর্তমানে কম পরিমাণ পণ্য কেনা যাচ্ছে। এতে সমাজের দৈনিক মজুরিতে আয়-রোজগার করা মানুষগুলোর পণ্য কিনতে বেগ পেতে হচ্ছে।

বিগত পাঁচ বছরে করোনাভাইরাস ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক ও জাতীয় রপ্তানি প্রবাহ কমে যায়, কমে যায় রেমিট্যান্স প্রবাহও। এর ফলে আমদানির জন্য ডলারের ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপাতে হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এবং ঋণখেলাপি বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তারল্য সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফলাফল হিসেবে আমরা দেখি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেকর্ড পরিমাণে টাকা ছাপানোর মতো অর্থনীতির অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতির লাগামহীন উলস্নম্ফন পরিলক্ষিত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামেও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।

এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫.৫৯ শতাংশ, যা ২০১৮ সাল থেকে ০.০৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০২০ সালে মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়ায় ৫.৬৯ শতাংশ, যা ২০১৯ সাল থেকে ০.১ শতাংশ হারে বেড়েছে। আবার ২০২১ সালে মুদ্রাস্ফীতি ০.১৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৫ শতাংশে। করোনাভাইরাসের কারণে ২০২২ সালে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৭.৭ শতাংশ, যার রেশ ধরে মুদ্রাস্ফীতি ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়ায় ৯.৪ শতাংশে, যা বর্তমানেও ৯ শতাংশের বেশি।

মুদ্রাস্ফীতির তিনটি মূল প্রভাবক হচ্ছে- সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা, আর্থিক নীতি ও আন্তঃবাজার গতি-প্রবাহ। গৃহস্থালি যেসব পণ্যগুলো উৎপন্ন হয়, তা ভোক্তার কাছে সরবরাহ শৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে পৌঁছতে খরচ বেড়ে যায়। কিছু সংখক লোক অধিক মুনাফার আশায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের ইচ্ছায় বাজারের দাম নির্ধারিত হয়। ফলে উৎপাদনকারীরা ন্যায্য অর্থ না পেলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিকই লাভবান হচ্ছে। যদিও অনেকের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেটের একচেটিয়া তথা মনোপলি আধিপত্য বিস্তার করছে। তবে দেশের বাজারে অলিগোপলিও বলবৎ রয়েছে, অর্থাৎ যেখানে ক্রেতা অনেক কিন্তু সরবরাহকারী গুটি কয়েকজন। যেমন- টেলিযোগাযোগ বাজার। চার থেকে পাঁচটি কোম্পানি পুরো বাজার দখল করে আছে। ভোজ্যতেলের বাজারও অলিগোপলির আওতাভুক্ত বলা যায়।

সম্প্রতি ডিম, পেঁয়াজ, গোল আলু, চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেগতিকভাবে বেড়েই চলছে। উদাহরণস্বরূপ, রমজান উপলক্ষে আমদানি করা প্রতি কেজি খেজুরে খরচ হয় ১০৫ টাকা থেকে ১১০ টাকা, কিন্তু বাজারে খেজুরের দাম অন্তত ৪৫০ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে বার বার পদক্ষেপ নিলেও সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যার ফলে মানুষের পণ্য ভোগ করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ধনী ও গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।

নতুন টাকা ছাপানো, মাত্রাতিরিক্ত ঋণখেলাপি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে দেশের রিজার্ভ কমে যায়, যার ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে। মুদ্রাস্ফীতি কমানের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ কার্যকরের চেষ্টা চলছে। যার মধ্যে একটি হলো- সুদের হার বাড়িয়ে বাজার থেকে অর্থ সরবরাহ কমানো। এর ফলে আমদানিকৃত এবং দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বাজার ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। অদূরদর্শী ও সামঞ্জস্যহীন পদক্ষেপ ভোগান্তি বাড়ানো বৈ কমাবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে