জীবন পোড়ে অবহেলায়
প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মীর আব্দুল আলীম, মহাসচিব কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
আমরা আত্মঘাতী? এত কিছুর পরও সচেতন হই না, রাষ্ট্র সজাগ হয় না। তাই জীবন পোড়ে অবহেলায়। রাজধানীর বেইলি রোডতো প্রিয়জনদের নিয়ে অবসর আর আনন্দে কাটানোর জায়গা। সন্তান কিংবা প্রিয়জনদেনর নিয়ে যদি লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় এর চেয়ে বেদনার আর কি হতে পারে। দিবারাত্র প্রাণচঞ্চল প্রাণোচ্ছল বেইলি রোডের একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ভবনটিতে ছিল শপিংমল আর খাবারের দোকান। মজাদার খাবার খেতে আর শপিং করতে সবাই যখন ব্যস্ত তখন ঘটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা। ভবনের নিচ তলায় একটি ভবনে আগুন লাগলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় তাৎক্ষণিক আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় পুরো ভবনটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৪ জন। আহত হয়েছেন অনেকে।
এমন দুঃসংবাদ শুনতে আর ভালো লাগে না। মানুষের জীবন এতটা তুচ্ছ! এসব হতাহতের দায় কে নেবেন? খোদ ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। তাহলে এ দায় কি ভবন মালিক নেবেন? সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব হয়তো নেই। থাকলে ফিবছর রাজধানীতে মানুষ আঙ্গার হতো না। ভবনটিতে যারা ব্যবসা করেন তারা কি এ দায় এড়াতে পারেন। নিজেদেরও তো পর্যাপত্ম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা জরুরি ছিল। এমন ঘটনা সব সময়ই ঘটছে এ দেশে। এসবের কেউ দায়িদায়িত্ব নিতে চায় না। প্রতিটা ঘটনারই তদন্ত কমিটি হয়। কারো সাজা হতে তেমন শোনা যায় কি?। প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু কারো ওপর দায় চাপে না। তাই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের অগ্নিকুন্ডলিতেই বসবাস করতে হয়। আর গুটি কয়েকজনকে লাশ হতে হবে এটাই স্বাভাবিক!
অগ্নিকান্ডের আগের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিলে হয়তো অঙ্গার হওয়া লাশ আর দেখতে হতো না। প্রতিটা ঘটনার পর বিল্ডিং ত্রম্নটি আর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার কথা শুনি। তদন্ত কমিটির কথা শুনি। সরকারও নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ক'দিন পরই সবাই সব বেমালুম ভুলে যায়। তাই অবহেলা-উদাসীনতা-দায়িত্বহীনতার আগুনে পুড়ছে মানুষ। যদি জীবনের দাবিই প্রাধান্য পেত তাহলে রাজধানীর বিল্ডিংগুলোতে বিকল্প সিঁড়ি আছে কিনা আর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করত সরকার সংশ্লিষ্টরা।
অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে, মানুষ মরছে কিন্তু কেন হচ্ছে এমন পুনঃপুন। আমাদের সক্ষমতার অভাব, না সচেতনতার অভাব? নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবগুলোই কারণ। বলা যেতে পারে, ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশ এবং সরু রাস্তা। এখানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে ভয়াবহতা তাড়াতাড়ি বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। ২৯ ফেব্রম্নয়ারির বেইলি রোড়ের অগ্নিকান্ড বা ট্র্যাজেডি কিন্তু আমাদের আবারও সতর্ক বার্তা দিয়ে গেল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। আমরা যদি সচেতন না হই বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করি ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে।
প্রতিটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতিহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোনো স্থাপনায় আগুন বড় আকারে জ্বলে উঠলে সর্বোচ্চ মানের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায়ও সেখানে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের মৃতু্য ও আহত হওয়া এড়ানো দুরূহ হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা স্থাপনার পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থার নকশা করা ও তা যথাযথ পরিপালন করা এবং সেটা নিয়মিত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সেই স্থাপনা ব্যবহারকারীদের জীবন ও সম্পদের অগ্নিনিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব। সবার এ বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক।
গ্যাসের চুলা, খোলা চুলা, শর্টসার্কিট, সিগারেটের আগুন, গ্যাসলাইনের ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদু্যতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কারণে অহরহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারসামগ্রী পৌঁছাতে কষ্টসাধ্য, অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ে না থাকা বা মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যবস্থা, ঢাকার আশপাশে বা মধ্যের নদী-খালের পানিশূন্যতার কারণে উদ্ধার কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে সংঘটিত অগ্নিকান্ড থেকে প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটু সচেতনতা হলেই অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত বা ক্ষতির হার কমে যেত। অগ্নি প্রতিরোধ সামগ্রীর মূল্য খুব বেশি নয়। অনেক সময় গড়িমসি করে পুরনোসামগ্রী বদলানো হয় না। আবার ভালো মানের বৈদু্যতিকসামগ্রী ব্যবহার করলেও দুর্ঘটনা অনেক কমে যেত। কিছু অর্থ কম করার জন্য আমরা অনেক সময় নিম্নমানের বৈদু্যতিকসামগ্রী ব্যবহার করি। কিন্তু একটু সচেতন হলেই দুর্ঘটনার হার বা ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমানো যেত।
ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একইসঙ্গে পর্যাপ্ত ফায়ার সার্ভিসের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর ২০১১ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা শহরে প্রতি ৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭০ অধিবাসীর জন্য মাত্র একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসের সংখ্যা যেমন কম, তাদের জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিরও অপ্রতুলতা রয়েছে। অনেক কর্মীও উদ্ধারকাজের সময় মারা যান নিরাপত্তার কারণে। পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে প্রেরণ ও যথাযথ চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় স্বাস্থ্য খাতকে। তাছাড়া বাংলাদেশের শহরগুলোয় অগ্নিকান্ডে আহতদের চিকিৎসা দেয়ার মতো ঢাকার তুলনায় লোকবল ও সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। পুরো দেশজুড়েই অপরিকল্পত নগরায়ণের চিত্রটি সামনে আসে অগ্নিদুর্ঘটনার সময়ে। এছাড়া নীতিমালা লঙ্ঘন, জবাবদিহির শিথিলতা, অসাবধানতা এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে- যা কমবেশি সবাইকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর চকবাজার এলাকা। কেমিক্যালের গোডাউনে ঠাসা পুর এলাকা। আগুন লাগলে তো মানুষ মরবেই। আগুনে মানুষ মরে কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগের টনক নড়ে না। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয় অনেক পরিবারকে। মূলত কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনেই সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়। গোডাউনের অতি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সম্পদের সঙ্গে মানুষও আঙ্গার হয়। কেমিক্যাল গোডাউন ঘনবসতীপূর্ণ এলাকায় যেখানে সেখানে হলে মানুষতো পুড়ে মরবেই। এত প্রাণ যাওয়ার পরও প্রশ্ন হলো রাজধানীর ঘনবসতিপূণ এলাকা থেকে কি কেমিক্যাল গোডাউন সরানো হয়েছে আদৌ!
রাজধানী ঢাকায় ভবন নির্মাণে আইন মানা হয় না, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকে না। থাকে না বিকল্প সিঁড়িও। আগুন লাগলে নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব আছে। সবখানেই সমস্যা! তাহলে বাঁচার উপায় কি? আগে অসভ্যতার আগুন নেভাতে হবে। অসভ্যতার আগুন নেভায় সাধ্য কার? সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর হতেই হবে নইলে ফি বছর আমরা এভাবে আগুনে পোড়া লাশ দেখতেই থাকব। ২৯ ফেব্রম্নয়ারি বেইলি রোডের যে বহুতল ভবনে আগুন লেগেছে সেখানে অগ্নিনির্বাপণের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না বিকল্প সিঁড়িও। তাহলে মানুষ পুড়ে আঙ্গারতো হবেই। সবখানেই অসভ্যতার ছোঁয়া- তাহলে আগুনে পুড়ে মানুষতো মরবেই! পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা রয়েছে। এসব গোডাউন ও কারখানায় বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ থাকায় আবাসিক এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো সরনোর কথা। উচ্চ আদালতেরও নির্দেশ ছিল। কে সরাবেন? কে শোনে কার কথা? যারা কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরানোর কাজ করবেন তারা তো নগদ নারায়ণ পেয়ে বিলাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই যা হওয়ার তাই হয়। এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হলো, অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে এত উদাসীনতা কেন? বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ মানুষের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার কিছু বিধিমালা নির্ধারণ করে দিলেও তার কেন প্রয়োগ নেই ভবনগুলোতে। ঢাকার বেশিরভাগ বহুতল ভবনে যথাযথ অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না থাকায় যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কায় থাকে নগরবাসী। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে ঢাকার জনবহুল ভবন বিশেষ করে হাসপাতাল, শপিং মল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দুই হাজার ৬১২টি ভবনের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে। সেখানে মাত্র ৭৪টি ভবন ছাড়া বাকি সব ভবন, অর্থাৎ দুই হাজার ৫৩৮টি ভবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে।
অগ্নি দুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ফায়ার হাইড্রেন্ট। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। নিমতলী এবং চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।
রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই ঠিকঠাক জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও। সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা অনুসরণ না করে তৈরি হওয়া ভবনগুলো পরিণত হয়েছে মৃতু্যফাঁদে! ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে ভবন মালিকদের নোটিশ দিলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না ভবন মালিকরা। এমনকি নোটিশের জবাবও দেন না। ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণে নিয়ম না মানা এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা না মানার ফলে বারবার মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অগ্নিকান্ডের ফলে প্রাণহানি, আহত হওয়ার ঘটনা ও সম্পদের ক্ষতি বেড়েই চলেছে। বছরে কয়েকশ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে অগ্নিকান্ডে। অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আগুন লাগলে মানুষ যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশস্ত সিঁড়ি এবং এক ভবন থেকে আরেক ভবনের প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করা জরুরি।