কোভিড ১৯-এর ধকল পৃথিবীবাসী কাটিয়ে উঠল এইতো কিছুদিন আগে। কিন্তু এখনো পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা রোগ মহামারি আকার ধারণ করে। কিছুদিন আগেও পশ্চিম এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুটি ইবোলা মহামারি সংঘটিত হয়। এর পেছনে হয়ত আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব অনেকাংশেই দায়ী। আমরা মূলত মনোযোগ দেই যে, কীভাবে কোনো প্রাদুর্ভাব ছড়ালে যত দ্রম্নত সম্ভব, এর মোকাবিলা করব। যদিও এটা মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার না। এর জন্য কোভিড ১৯ ভাইরাসের দিকেই তাকানো যাক। এই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানুষ জানার অনেক আগেই যে, তারা অসুস্থ। অনেক সময়ই এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। আমাদের বুঝে ওঠার আগেই কোনো ভাইরাস মহামারি অনেক সময় অতিমারি আকার ধারণ করে বসে। এসব প্রাদুর্ভাবের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং সারিয়ে তোলা নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু এটাই যথেষ্ট নয়। কেমন হতো যদি আমরা কোন প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগেই আটকাতে পারতাম? খুশির খবর হলো, আমরা পারি এমনটা করতে। কিন্তু কীভাবে তা জানলে অনেকে আশ্চর্য হবেন।
কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা মহামারির উৎপত্তি হয়েছিল কুঠারের আঘাতে। গিনিতে বসবাসকারী কিছু সম্প্রদায় তাদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষেত-খামার করতে গাছ কাটতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে একটি ১৮ মাস বয়সের ছেলে ইবোলাতে মারা যায়। বিশ্বাস করা হয়, যেখানে সে খেলছিল, তারা আশপাশের গাছের বাঁদুড় থেকে এই ভাইরাসটি তাকে আক্রমণ করে। সেখান থেকেই ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় ১১,০০০ মানুষ মারা যায়।
শুধু ইবোলাই না, ১৯১৮-২০০৯ পর্যন্ত যে পাঁচটি ব্যাপক মহামারি ছড়িয়েছে, এর উৎস মূলত বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী। কোভিডের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকাংশেই সত্যি। যেসব অনাবিষ্কৃত ভাইরাস পশুপাখির মাধ্যমে ছড়ায়, আগামীতে সেসব ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাব্য সংখ্যা ৬,০০,০০০ এর ওপর।
এসব ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পেছনে অনেকাংশে আমরা নিজেরাই দায়ী। বন্যপ্রাণী বাণিজ্য, বাণিজ্যিকভাবে পশুর খামার এবং ট্রপিকাল বা গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন উজাড় করা এর অন্যতম কারণ। আজকে আমরা বননিধন ও মহামারির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। বন ব্যবহার পদ্ধতির পরিবর্তন বিশেষত বননিধন হয়ত পশুবাহিত রোগের সবচেয়ে বড় কারণ। এপিডিমিক ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের অন্যতম প্রধান ডাক্তার নীল ভোরা এর মতে, প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে বননিধনের থেকে রোগের উৎপত্তি হয়। প্রথমত, এমন প্রাণীর মাধ্যমে যেগুলো বনায়নের মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। যেমন কিছু প্রকৃতির বাঁদুড়। এসব প্রাণী প্রায়ই এমন কিছু জীবাণু বয়ে বেড়ায়, যা আমাদের নানাভাবে সংক্রমিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, যখন মানুষজন বন উজারকৃত এলাকায় স্থানান্তরিত হয় তখন তারা বন্যপ্রাণীর অনেকটা কাছাকাছি চলে আসে। যার কারণে জীবাণু আদান-প্রদানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়। তৃতীয়ত, প্রাণীরা অনেক ক্ষেত্রেই তার ঘর হারানোর পীড়নে বেশি করে রোগ ছড়াতে পারে। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হলো, আমাদের গ্রহ যত উষ্ণতর হবে, এসব সংক্রামক রোগের ঝুঁকি ততই বৃদ্ধি পাবে। মানুষের মধ্যে ছড়ানো পরিচিত সংক্রামক রোগের অর্ধেকেরও বেশি কোনো না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত। এমনকি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন জলবায়ু পরিবর্তনকে মানব স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছে।
অনেকেই বলতে পারে, তাহলে তো বাঁদুড়গুলোকে মেরে ফেললেই হয়। না থাকবে বাঁশ আর না বাজবে বাঁশি। মোটেই না। যদি আমরা তাদের মেরে ফেলি, তাহলে আমরা আরও বেশি ভাইরাস আক্রমণের শিকার হব। কেননা, আমরা পরাগায়ন এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তারা অনেক ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে ফেলার মাধ্যমে পরিবেশের উপকার সাধন করে থাকে। কিন্তু কিছু কাজ আমরা এখনই করতে পারি, যা আমাদের স্বাস্থ্য এবং জলবায়ুর ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়াও আগামী কোনো মহামারি মোকাবিলা করার চেয়ে এটা অনেক সহজলভ্যও। কি সেটা? সেটা হতে পারে ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন সংরক্ষণ করার মাধ্যমে। মানুষজন অবশ্যই মজা করার উদ্দেশে বনা উজাড় করে না। হয় বিভিন্ন করপোরেশন বৈশ্বিক বাজারে অর্থ উপার্জন করার জন্য এটা করে থাকে আর না হয় বিভিন্ন রেইন ফরেস্টের সম্প্রদায়গুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য গাছ কাটতে বাধ্য হয়। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই বহুমুখিতার ব্যাপারে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। যেমন একাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রাজিল সরকার স্যাটেলাইটের সাহায্যে কতটুকু বনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করে। পরে তারা অবৈধ বননিধনের ব্যাপারে প্রচন্ড কঠোর হয়। তারা সেখানকার স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর কাছে এলাকাগুলো প্রত্যাবর্তন করে, যারা হাজার বছর ধরে সেসব এলাকায় সফলতার সঙ্গে বসবাস করে আসছে। জনসাধারণের চাপের মুখে পড়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সদ্য বননিধনকৃত এলাকা থেকে গরুর মাংস এবং সয়া বিক্রি করা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ফলশ্রম্নতিতে ২০০৪-২০১২ সালে অ্যামাজন এলাকায় প্রায় ৮০ শতাংশের অধিক বননিধন কমে যায়। এ ছাড়াও কৃষিজ উৎপাদনও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সমস্যা হলো, বননিধনের ক্ষেত্রে এক সমাধান সব জায়গায় খাটে না। ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিওতে হেল্থ অ্যান্ড হারমোনি নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বননিধনের ব্যাপারে সেই অঞ্চলের মানুষের অভিমত জানতে চায়। তাদের মতে, বননিধন রোধ করা যেতে পারে, যদি মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা এবং উন্নত চাকরি প্রদান করা যায়। অতপর কিছু আঞ্চলিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি সেই এলাকায় একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়াও, তারা সেই এলাকার লোকদের অর্গানিক উপায়ে খামার করার প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং বিনিয়োগ করে যুবশিক্ষা খাতে। পরে দেখা যায় যে, তাদের কথাই ঠিক ছিল। পরবর্তী দশকেই উক্ত এলাকায় বননিধন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতেও ঘটে ব্যাপক উন্নতি। আবার নবজাতক মৃতু্যহারও দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। পরিশেষে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের কাছে বননিধন রোধের সমাধান আছে। প্রয়োজন শুধু বিজ্ঞতার সঙ্গে সেগুলো প্রয়োগ করা। এতে যেমন বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যাবে, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনকেও ধীর করা যাবে। যেসব উপাদান আমরা মহামারি মোকাবিলা করতে ব্যবহার করি যেমন- ওষুধ, টিকা এমনটি তথ্য-উপাত্ত সেগুলো দিয়ে পৃথিবীর অনেক মানুষের উপকার হয়। কিন্তু প্রতিরোধ পৃথিবীর সবাইকে সমানভাবে উপকার করে। এতে শুধু মানুষই না উপকৃত হয়, পশু প্রাণী অর্থাৎ পুরো গ্রহ। কেননা, দিনশেষে মানবস্বাস্থ্য, পশুস্বাস্থ্য বা পরিবেশগত স্বাস্থ্য বলতে কিছু নেই। সবই এক। মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতির সঙ্গে আমরা যেমন ব্যবহার করব, প্রকৃতিও আমাদের সঙ্গে ঠিক তেমনই ব্যবহার করবে।