২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্য বিশ্বব্যাংকের দৃঢ় সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস) আন্না বিজার্ড। গত ২৫ ফেব্রম্নয়ারি দেশে তার প্রথম সফর শেষে বিজার্ড বলেন, 'অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে জরুরি ভিত্তিতে গভীর সামষ্টিক ও অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গল্প অনেক দেশের জন্য অনুপ্রেরণামূলক।' তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অংশীদারত্ব নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন। এ কথা সত্য যে, সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয় বেশ কিছু সূচকের ঊর্ধ্বগামী গতিধারা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীতে টানেল, তৃতীয় পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের অন্যতম। এছাড়াও জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, সর্বোপরি গড় আয়ু বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বার্তাই প্রকাশ করে থাকে। তবে বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের অনেক উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে নানাভাবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার হার প্রায় ২০% এর নিচে চলে এসেছে।
কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক টানাপড়েনের মাত্রা এতটা বেশি যে, অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন যাত্রা ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং রাজনীতিতে পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাস শক্তিশালী হলে দেশের উন্নয়ন সূচক আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যেই 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গঠনের যে প্রতিশ্রম্নতি ছিল তা দৃশ্যমান হয়েছে। ২০২৮ সালের নির্বাচনে প্রতিশ্রম্নতি ছিল 'আমার শহর আমার গ্রাম'- সেটিও এখন হাতের নাগালে। ২০৪১ সালকে সামনে রেখে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ স্মার্ট বাংলাদেশ। এই স্মার্ট বাংলাদেশ সহজ করবে মানুষের জীবনযাত্রা, হাতের মুঠোয় থাকবে সবকিছু। অন্যদিকে, ২০৪১ সালেই শেষ নয়, ২১০০ সালেও এই বঙ্গীয় বদ্বীপ যেন জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পায়, দেশ উন্নত হয়, দেশের মানুষ যাতে 'সুন্দর, সুস্থ এবং স্মার্টলি' বাঁচতে পারে, সেজন্য ডেল্টা পস্ন্যানের কাজ চলছে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশ ও স্মার্ট দেশে রূপান্তরের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই দেশের উন্নতি এবং অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে সব ভেদাভেদ ভুলে দেশের মানুষের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা জরুরি।
চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের সুফল গ্রহণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে প্রয়োজন স্মার্ট সিটিজেন। ভবিষ্যতে যাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকবে, তারাই ভালো কাজ পাবে।
বিগত ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যে উন্নয়ন কার্যক্রম করেছে তা অনেকটা অভাবনীয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জনে এক ধাপ এগিয়ে। বঙ্গবন্ধুর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আদর্শকে সামনে নিয়ে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- পররাষ্ট্র নীতি সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।
অর্থনৈতিক সূচকে দেশের অগ্রগতি এখন বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু এই উন্নয়নযাত্রাকে সামনে দিকে এগিয়ে নিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতিকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা জরুরি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদন, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সময় দেশের সাক্ষরতার হার মাত্র ২৫ শতাংশ ছিল। বর্তমানে তা ৭০ শতাংশের বেশি হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের তালিকাভুক্তি এখন ৯০ শতাংশের বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার, সর্বকালের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। তাদের মধ্যে ১৮.৭ শতাংশ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং অন্য ৫.৬ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। ১৯৭১ সালে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯১ ডলার। বর্তমানে তা প্রায় ৩ হাজার মার্কিন ডলার। নারীরা এখন আমাদের জাতীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।
গত ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের অধিবেশনের শুরুতেই রাষ্ট্রপতির দেওয়া বক্তব্য থেকে দেশের উন্নয়নের সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায়। রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশের বেকারত্বের হার ২০১০ সালে ছিল ৪.১০ শতাংশ- যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩.২ শতাংশে। আমাদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪৫ ভাগ- যা আজ ৭৬.৮ ভাগে উন্নীত হয়েছে; আয়ুষ্কাল ৫৯ বছর থেকে প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃতু্য উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, শিশুমৃতু্য হার হ্রাসে সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ পেয়েছে এমডিজি পুরস্কার, চিকিৎসাসেবা আজ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। বিদু্যৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট- যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যেই দেশের শতভাগ মানুষ বিদু্যৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বাংলাদেশের জন্য মর্যাদাপূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রের অধিকাংশ স্থাপনার নির্মাণকাজ এবং পরমাণু জ্বালানি হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে। এ বছর এ কেন্দ্র হতে উৎপাদিত বিদু্যৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, ব্যাংকিং, প্রশাসন, উদ্ভাবন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল অর্থনীতি, আইসিটি শিল্পসহ প্রায় সব খাতে সমভাবে উন্নতি হয়েছে। বিগত বছরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতের নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নে সাফল্যের স্বীকৃতস্বরূপ বাংলাদেশ ভূষিত হয়েছে অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে। তবে, নতুন সরকারের সামনের রাস্তা মোটেও মসৃণ নয়। তাদের একেকটি বাধার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে- যা একটি অপরটির চেয়ে কঠিন। অবকাঠামোগত ও সেবামুখী সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সত্ত্বেও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে আরও মজবুত করা প্রয়োজন।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়