ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ বা মৃতদের তালিকায় বারবার ওঠে আসছে বাংলাদেশিদের নাম। অবৈধ পথে ইউরোপে গিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পাওয়ার আশায় অবর্ণনীয় পরিস্থিতি ও নির্মম নির্যাতনের শিকারই শুধু নয়, জীবন ঝুঁকিতে ফেলছেন বাংলাদেশি তরুণরা।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার তথ্য বলছে, শুধু গত বছরই প্রায় ১৩ হাজার বাংলাদেশি সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছেছেন। এর আগে ২০২২ সালে সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের তিনটি জেলা থেকে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। নতুন করে মানবপাচারের 'হটস্পট' হয়ে উঠেছে কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর জেলা। এগুলোতে নজর রাখার পাশাপাশি যেসব জেলায় মানব পাচার আইনে অতিরিক্ত মামলা আছে, সেসব জেলায় আরও বেশি বিশেষ ট্রাইবু্যনাল করার কথা ভাবছে সরকার। গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপ যাত্রাকালে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকায় আগুন লেগে মারা যান ৮ বাংলাদেশি। ওই নৌকা থেকে ২৭ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। নিহত ৮ জনের মধ্যে ৫ জনই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূল থেকে এক অপ্রাপ্তবয়স্কসহ ৩০ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে ফরাসি দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) উদ্ধারকারী জাহাজ জিও ব্যারেন্টস। সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশ থেকে পেস্ননে বাহরাইন ও ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি পৌঁছান তারা। সমুদ্রযাত্রার আগে মানবপাচারের দালালদের কাছে তিন-চারদিন বন্দি থাকতে হয়। খাবার ও পানির কষ্ট ছাড়াও সইতে হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। ইউরোপ পৌঁছে যাওয়া বা বিভিন্ন সময় নৌকা থেকে উদ্ধার পাওয়া অনেকেই নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা জানিয়েছেন।
এমন মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে সাগরপথে বিদেশে পাড়ি জামাতে গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন লোকজন। এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মানব পাচারের শিকার হওয়ার পর বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাচারকারীরা অন্তত ১৮টি রুট ব্যবহার করে।
মানব পাচার বাংলাদেশের অন্যতম শিরঃপীড়ায় পরিণত হয়েছে। জল, স্থল ও আকাশপথে প্রতিদিন মানব পাচার চলছে। মূলত জীবন ও জীবিকার কারণে, দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে, দারিদ্র্যের পীড়নে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। এসব মানুষের বেশিরভাগই প্রতারিত হচ্ছে, হচ্ছে সর্বস্বান্ত। একটা সময় শুধু রোহিঙ্গা পুরুষরা কাজের তাগিদে সাগর পাড়ি দিতেন। এখন কিন্তু নারী ও শিশু পাচারও বাড়ছে। অবৈধভাবে দেশের বাইরে যাওয়ায় বাংলাদেশের অনেক অভিবাসী মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছেন। চলাচলে সীমাবদ্ধতা, ঋণের চক্রে পড়া, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিয়ে এবং দাসত্বের মতো শোষণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন অভিবাসীরা। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারী-পুরুষ এবং শিশুরাই মানব পাচারকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে যেসব মানুষ পাচারের শিকার হন, তাদের ৫১ শতাংশই পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে ভাগ্য ফেরাতে গিয়ে বা অর্থনৈতিক কারণে।
আমরা মনে করি, মানব পাচার বন্ধ না হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কাজেই কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও বিজিবিসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও নজরদারি বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনে সীমান্তের সক্ষমতা বাড়িয়ে পাচার বন্ধ করতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই।