মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন-২০২৪

বিশ্বশান্তির জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বিশ্বনেতারা যদি বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নেন এবং যে কোনো মূল্যে যুদ্ধের অবসানের পথ খুঁজে বের করার জন্য আলোচনা করেন, তাহলে বিশ্ববাসী সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব। এ ব্যাপারে এখনই প্রয়োজন দৃঢ়চেতা ও সাহসী বিশ্বনেতৃত্ব।
মো. সাখাওয়াত হোসেন
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিশ্বশান্তির জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?

মানবতার সুরক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ এবং সংঘাত থেকে দূরে সরে এসে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি বিশ্বকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। শুক্রবার জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার সারাংশ ছিল এটি। জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ছয় দফা প্রস্তাবের প্রত্যেকটা প্রস্তাবই গুরুত্বপূর্ণ; যেমন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো যে অঙ্গীকার করেছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রম্নতি পালন করা, বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যাকান্ড থেকে সরে আসা, জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য যে অর্থায়ন বর্তমান হারকে অন্তত দ্বিগুণ করতে হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল পাওয়ার পথ সুগম করার দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক অর্থায়নে সংস্কার বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঋণের বোঝা ব্যবস্থাপনায় অনুদান ও ঋণের ছাড়ে সুযোগ বাড়ানো, জলবায়ু কর্মের জন্য ব্যক্তিগত পুঁজি প্রবাহকে একত্রিত করার জন্য সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ এবং উপকরণে বিনিয়োগ করা।

বিশ্বসংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশি রেসিপিটি সহজ : আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য নিরসন করুন, যুদ্ধ বা সংঘাতের মাধ্যমে নয়, জলবায়ু অর্থায়নের মাধ্যমে জনগণের জন্য কল্যাণমূলক কার্যক্রম বজায় রাখুন। বিশ্বজুড়ে অস্ত্র ও যুদ্ধের পেছেনে অর্থ খরচ না করে তা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন করার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ থেকে অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়, যা ইতিমধ্যে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবনকে কেড়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন যে, জটিল বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কগুলোকে কাজে লাগানোর এবং শুধু তাদের নিজ নিজ দেশের জন্য নয়, মানবজাতির জন্যও ইতিবাচক ফলাফল আনার এখনই উপযুক্ত সময়। সুতরাং, অর্থহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের জন্য সবাইকে এক হতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, মানবতার অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে, তখন সংকীর্ণ স্বার্থের পেছনে ছুটলে কোনো লাভ হবে না।

উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে গাজা সংঘাত এ পর্যন্ত ২৮,৫০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং অনেক ফিলিস্তিনি শহরে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিশ্ববাসী রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে গত তিন বছর ধরে আরেকটি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে। প্রকৃতপক্ষে, এই যুদ্ধটি বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গলার কাঁটা হয়ে রয়ে গেছে এবং এর ফলে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, বৈশ্বিক পণ্য ও জ্বালানি বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব এবং আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে খরার কারণে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও, আর্থিক এবং জ্বালানি সংক্রান্ত বিষয়গুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসডিজি অর্জনে ব্যাপকভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। বিগত কয়েক বছরের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংকটগুলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য, শক্তি এবং পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, মহামারী থেকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দিয়েছে।

জ্বালানি ও খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় উলেস্নখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রক্তক্ষয়ী গাজা-ইসরাইল ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও বিশ্বনেতাদের শান্তির বার্তা দিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ করে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।

এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও সংঘাতের প্রভাব অনুধাবন করে শেখ হাসিনা অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে এবং যুদ্ধরত দেশগুলোর ওপর অস্ত্র সরবরাহের সমর্থন প্রত্যাহার করে বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি স্পষ্ট আহ্বান জানান। তিনি সমগ্র মানবতাকে বাঁচানোর স্বার্থে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কাটানোর জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতার কথা বলেন। এই প্রেক্ষাপটে, মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ২০২৪-এ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রম্নতির বাস্তবায়নের সাম্প্রতিক আবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অস্ত্র প্রতিযোগিতা যখন পুরোদমে চলছে, তখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, উন্নত দেশগুলো এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ার প্রতিশ্রম্নতি পূরণ করতে পারেনি। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে তার জলবায়ু প্রভাব প্রশমনে অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ শুধু বিদেশি তহবিলের অপেক্ষায় বসে থাকেনি। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নিজস্ব জলবায়ু অভিযোজন নীতি গ্রহণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এখন পর্যন্ত নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪৮০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রায় ৮০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

\হকিন্তু বাস্তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করতে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যা ব্যয় করেছে তা খুবই অপর্যাপ্ত। দেশটির জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বছরে কমপক্ষে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি মূল বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং আমাদের সরকারপ্রধানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এতটা সাহসীভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে দেখে ভালো লাগছে। আমাদের মানবজাতির ইতিহাসের এই পর্যায়ে জলবায়ু সংকট কতটা অনিবার্য হয়ে উঠেছে তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।

অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য শেখ হাসিনার সময়োপযোগী আহ্বানকে আমরা অত্যন্ত প্রশংসা করি। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করি যে বিশ্বনেতাদের বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও সংঘাতের ইন্ধনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। যেহেতু বিশ্ব আমাদের সমগ্র প্রজাতির জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় অস্তিত্বের হুমকি, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করছে, বিশ্ব নেতাদের বুঝতে হবে যে, এটি এমন একটি যুদ্ধ যা প্রতিটি জাতি একই সঙ্গে না থাকলে লড়াই করা যাবে না।

প্রধানমন্ত্রী যে ছয়টি পয়েন্ট রেখেছেন, যা বিশ্ব নেতারা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য অর্থায়ন প্রশমন এবং অভিযোজন ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলা করা। বিশ্বকে অবশ্যই যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্বুদ্ধিতা হত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে, যা বিশ্ব গাজা এবং অন্যত্র প্রত্যক্ষ করছে। নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাবও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে অনেক দূরে অনুভূত হয়। প্রশমন এবং অভিযোজনের জন্য অর্থায়নে ভারসাম্যহীনতা দূর করে বর্তমান অভিযোজন অর্থায়নকে অন্তত দ্বিগুণ করে জলবায়ু সমস্যা সমাধান করা দরকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে জলবায়ু অভিবাসীদের বোঝা ভাগাভাগি করার জন্য বাংলাদেশ সর্বদা একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক সংহতির আহ্বান জানায়।

বিশ্বনেতারা যদি বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নেন এবং যে কোনো মূল্যে যুদ্ধের অবসানের পথ খুঁজে বের করার জন্য আলোচনা করেন, তাহলে বিশ্ববাসী সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব। এ ব্যাপারে এখনই প্রয়োজন দৃঢ়চেতা ও সাহসী বিশ্বনেতৃত্ব।

প্রকৃত অর্থে, আমাদের গ্রহে খাদ্যের কোনো অভাব নেই তবে অভাবটি কেবল মানবসৃষ্ট। তাই অস্ত্রের খেলা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে।

মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে