মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল বরাত মাহমুদুল হক আনসারী

ইসলামের সঠিক আদর্শ প্রচার, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা করা সব ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ওপর অবশ্যই কর্তব্য। সঠিকভাবে ইসলামের কর্মপন্থা ও নিদের্শনা মুসলিম সমাজে বাস্তবায়নে প্রকৃত ওলামা মাশায়েখদের এগিয়ে আসা দরকার।
মাহমুদুল হক আনসারী : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট
  ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল বরাত মাহমুদুল হক আনসারী

শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে পবিত্র 'শবেবরাত' বলা হয়। শবেবরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। 'শব' মানে রাত, 'বরাত' মানে মুক্তি। শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবেবরাতের আরবি হলো 'লাইলাতুল বারাআত'। হাদিস শরিফে যাকে 'নিসফ শাবান' বা 'শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী' বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষায় যা 'শবেবরাত' নামেই অধিক পরিচিত।

কোরআনুল কারিমে এসেছে, 'হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।' (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-৫)। মুফাসসিরিনগণ বলেন: এখানে 'লাইলাতুম মুবারাকা' বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখানের দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবেবরাতকে বোঝানো হয়েছে। (মাআরিফুল কোরআন)।

হাদিস শরিফে আছে, 'হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, আলস্নাহ তাআলা অর্ধশাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।' (ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫, ইবনে মাজাহ: ১৩৯০, রাজিন: ২০৪৮; ইবনে খুজাইমা, কিতাবুত তাওহিদ, পৃষ্ঠা: ১৩৬, মুসনাদে আহমদ, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৬)।

হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুলস্নাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃতু্যবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, 'হে আয়শা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে?' আমি উত্তরে বললাম, 'ইয়া রাসুলুলস্নাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃতু্যবরণ করেছেন কি না।' নবীজি (সা.) বললেন, 'তুমি কি জান এটা কোন রাত?' আমি বললাম, আলস্নাহ ও আলস্নাহর রাসুলই ভালো জানেন।' তখন নবীজি (সা.) বললেন, 'এটা হলো অর্ধশাবানের রাত। এ রাতে আলস্নাহতাআলা তার বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থীগণ ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।' (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।

হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: নবীজি (সা.)-এ রাতে মদিনার কবরস্থান 'জান্নাতুল বাকি'তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়াবকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আলস্নাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি: ৭৩৯)।

রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। কেননা এদিন সূর্যাস্তের পর আলস্নাহতাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, 'কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।' এভাবে ভোর পর্যন্ত আলস্নাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উলেস্নখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)।

এ ছাড়া প্রতি মাসের ৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের নফল রোজা তো আছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ও পালন করতেন, যা মূলত সুন্নাত। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব (রা.) বলেন, এদিনের রোজা আইয়ামেবিদের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৫১)।

এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ। শবেবরাতের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি পদ্ধতিতে একদিন পর একদিন রোজা পালন করলেও প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয় এবং শবেবরাতের রোজার শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব-শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুলস্নাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)।

কোরআন এবং হাদিসের বিশুদ্ধ বর্ণনার মাধ্যমে পবিত্র শবেবরাত সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীতে মুসলিম বিশ্ব ভাবগাম্ভীর্যের সহিত পবিত্র শবেবরাত পালন করে থাকে। এ রাতে নফল ইবাদত, নামাজ, কবর জিয়ারত, কোরআন তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতগণ মহান এ রজনী উৎযাপন করেন। পবিত্র শবেবরাতের ইবাদত বন্দেগি সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের অকাট্য নির্ভুল দলিল থাকা সত্ত্বেও একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে পবিত্র শবেবরাত সম্পর্কে ইসলাম ও কোরআন হাদিসবিরোধী বক্তব্য রাখতে দেখা যায়। বলা যায়, ওই ধরনের বক্তব্য যারা রাখেন, মূলত: তাদের সঙ্গে ইসলামের মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তারা ইসলামের বাস্তব, নীতি, আদর্শ, তাহজিব, তমদ্দুন নিয়ে বিতর্ক করায় তাদের কাজ। ওইসব শ্রেণি-পেশার বিতর্কিত মহল থেকে সত্যিকার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীদের দূরে থাকতে হবে।

ইসলামের সঠিক আদর্শ প্রচার, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা করা সব ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ওপর অবশ্যই কর্তব্য। সঠিকভাবে ইসলামের কর্মপন্থা ও নিদের্শনা মুসলিম সমাজে বাস্তবায়নে প্রকৃত ওলামা মাশায়েখদের এগিয়ে আসা দরকার।

মাহমুদুল হক আনসারী : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে