২২ ফেব্রম্নয়ারি ২০২৪ দিনটি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য অবশ্যই অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এমন একটি দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন লক্ষ লক্ষ এমপিওভুক্ত শিক্ষক। তাদের মাঝে বিরাট প্রাপ্তির আনন্দ বয়ে যাচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে অবসরের ৬ মাসের মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পাওনা দিয়ে দিতে। অবসরের টাকা উত্তোলনে যে বিড়ম্বনা চলছিল সেটা থেকে শিক্ষকরা পরিত্রাণ পেতে চলেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই। তদুপরি, অবসরের টাকা পেতে ঘাম ঝরে যেত শিক্ষকদের। অনেক শিক্ষক আছেন যারা মারা গেছেন অথচ জীবদ্দশায় অবসরের টাকার মুখ দেখতে পারেননি। বয়সের ভারে জীবন যখন এমনিতেই চলতে চায় না, তখন অবসরের টাকা পেতে হিমালয়সম প্যারা জীবনকেই যেন অর্থহীন করে তোলে। বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের প্রাপ্তি খুবই কম। অবসরে গিয়ে এককালীন কিছু টাকার মুখ দেখতে পান তারা। কিন্তু সেটা পেতে যখন চটি ক্ষয় হয়ে যায় এবং ঘুষ দিয়ে টাকা পেতে হয় তখন সেটা আনন্দময় না হয়ে বিষময় হয়।
২০০৫ সাল থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের অবসর সুবিধা চালু করা হয়। শিক্ষক-কর্মচারিরা দু'টি সুবিধা পেয়ে থাকেন। একটি হলো সর্বশেষ বেসিকের ৭৫ মাসের টাকা (যদি চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হয়) যেটি পেনশন নামে পরিচিত। অন্যটি হলো কল্যাণ তহবিলের টাকা। তবে শিক্ষকরা এই সুবিধা বিনা শর্তে পান না। তাদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ হারে প্রতি মাসে বেতন থেকে কেটে রাখা হয়। ৬ শতাংশ অবসর ভাতার জন্য এবং ৪ শতাংশ কল্যাণ তহবিলের জন্য। পূর্বে ৬ শতাংশ কাটা হত। পরবর্তীতে ৪ শতাংশ যুক্ত করা হয়। শিক্ষক-কর্মচারিদের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হবার পর এই ৪ শতাংশ কর্তন শুরু হয়। এই কর্তন নিয়েও শিক্ষকদের মাঝে অস্বস্তি রয়েছে। যাহোক, শিক্ষক-কর্মচারিরা ১০ শতাংশ হারে দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অবসরে গিয়ে তাদের সেই গচ্ছিত টাকা ফেরত পেতে বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। পদে পদে হেনস্থা হতে হয় তাদের। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, আগের থেকে এখন হয়রানি অনেকটা কমেছে। তারপরও অবসর ভাতা পেতে তাদের বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। সরকার কয়েক ধাপে ঘাটতি পূরণে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। তারপরও সবার পাওনা পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে। এখনো ঝুলে আছে লক্ষাধিক ফাইল। শিক্ষকদের অবসর সুবিধার গিঁট ছাড়ানোর জন্য যেন কেউ নেই। শিক্ষক-কর্মচারিদের হাহাকার যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায় না।
আন্দোলন সংগ্রাম করতে করতেই শিক্ষকদের চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয়ে যায়। অভাব অনটনের সংসারে শুধু স্বপ্ন বুননই চলতে থাকে। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখা যায় না। বহুবার সংস্কার করার পরও অবসর সুবিধা পেতে শিক্ষকদের দৌড়ঝাঁপ চলে বিরামহীন। এখনো ৪/৫ বছর লাগে অবসরের টাকা হাতে পেতে। ৬০ বছর পর এমনিতেই বার্ধক্য ভর করে শরীরে, তার ওপরে অবসর ভাতাপ্রাপ্তির জ্বালা যেন জীবনকে দ্বগ্ধ করতে থাকে। শিক্ষক-কর্মচারিদের এই সমস্যা নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। অবশেষে হতাশ হৃদয়ে যেন আশার সঞ্চার হতে শুরু করেছে। আদালতের রায় যদি যথাযথভাবে মেনে চলা হয় তবে অসংখ্য শিক্ষককের সমস্যার সমাধান হবে।
সময়ের সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন হয়। বেসরকারি শিক্ষকের ভাগ্যের পরিবর্তন যেন কোনো জালে আটকা পড়েছিল। ধীরে ধীরে জট খুলতে শুরু করেছে। সরকারি চাকরিজীবীরা যদি তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবসরের টাকা পেয়ে থাকেন তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিরা কেন পাবেন না? এখন ডিজিটাল যুগ। প্রযুক্তি সব কিছুকে সহজ করে দিয়েছে। সব এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তথ্য-উপাত্ত এখন আপডেট আছে। কোন শিক্ষক কবে অবসরে যাবেন এটা কর্তৃপক্ষের খুব ভালো করে জানা আছে। তাই অবসরে যাওয়ার পর অনলাইনে আবেদন করলে খুব একটা বেশি সময় লাগার কথা নয় টাকা পেতে। বর্তমানে আবেদনের সঙ্গে ব্যাংক একাউন্ট নম্বর চাওয়া হয় এবং সেখানে টাকা জমা হয়। এটা খুব ভালো একটি দিক। অবসরের টাকা পেতে শিক্ষক-কর্মচারিরা ম্যানেজিং কমিটির দ্বারাও হেনস্তার শিকার হোন এমন খবর বহুবার পত্রিকায় এসেছে। সেটা থেকে আপাতত পরিত্রাণ মিলেছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে কোনো কিছুই কঠিন নয়। সদিচ্ছার প্রয়োজনটা সবচেয়ে বেশি দরকার। শিক্ষকদের আদালতের দ্বারস্থ হয়ে তাদের সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য লড়তে হচ্ছে। আদালত যে রায়টি দিয়েছে সেটি একটি যুগান্তকারী রায়। ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারির অবসর সুবিধা ৬ মাসের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। আদালতের এই নির্দেশনার পর বঞ্চিত শিক্ষকদের মুখে হাসি ফুটবে। কেননা অবসর সুবিধাপ্রাপ্তির জটিলতার মারপ্যাঁচে শিক্ষকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। প্রায়ই একটি কথা শোনা যায়, তহবিল সংকটের কারণে সবাইকে সময়মতো অবসর সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না। এই যুক্তি কতটা খাটে? সরকারি চাকরিজীবীদের বেলায় এমন কথাতো শোনা যায় না। আমরা পদ্মা সেতু বানাতে পারি, বঙ্গবন্ধু টানেল করতে পারি, পারমাণবিক বিদু্যৎ কেন্দ্র করতে পারি, অথচ শিক্ষকদের পাওনাটুকু সময়মতো বুঝিয়ে দিতে যত ঝামেলা। এক্ষেত্রে কেন অপারগতা? এখন মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় কোনো আগ্রহ দেখান না। আমার বাবা আজ থেকে ২৫ বছর আগে এমপিওভুক্ত স্কুল শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। তখন তিনি রিক্ত হস্তে বিদায় নিয়েছেন। কানাকড়িও জুটেনি তার বিদায় বেলায়। তাই আমার বাবা আমাদের শিক্ষকতা পেশায় যেতে বারণ করতেন। মহান পেশা হলেও তিনি এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা জ্বালাটি বুঝতেন। শিক্ষকতা মহান পেশা- এই বাক্যটির বহুমাত্রিক অপব্যবহার লক্ষ্য করি। শিক্ষকতা যদি মহান পেশাই হয় তবে শিক্ষকদের এত দৈন্য কেন? তারা এত অবহেলার শিকার কেন? কেন তাদের প্রাপ্তি পেতে এত গলদঘর্ম হতে হয়? মহান পেশাকে কেন এত হীন চোখে দেখা হয়? মুখে শুধু মহানের বয়ান আর জিকির তুলে কি বার্তা দেওয়া হয়? শিক্ষকদেরকে কেন দিনের পর দিন প্রেস ক্লাবে বসে দু'আনা প্রাপ্তির জন্য ছালায় শুয়ে রাত কাটাতে হয়। শিক্ষকের চোখে মরিচের গুড়ো নিক্ষেপ করা হয়। যতবার শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছে ততবার তারা চরম অপদস্তের শিকার হয়েছে। সাত পাঁচ দিয়ে একটি শিশুবুঝ দিয়ে তাদের আন্দোলনের মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে সবাই বড় বড় স্বপ্ন দেখে। সরকারের স্বপ্ন তো আরও বড়। কিন্তু শিক্ষকদের নিয়ে তাদের স্বপ্নগুলো এত ছোট কেন? যাদের দিয়ে শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তাদেরই যদি করুণদশা হয় তবে শিক্ষা কীভাবে আগে? সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার বৈষম্য কেন করা হচ্ছে? বর্তমানে স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক ১২,৫০০/- টাকা বেতন পান। কীভাবে তার সংসার চলে? তার হাড়ির খবর ক'জন রেখেছে? বেকারের যুগে হয়তো উপায় নেই। তাই ১২,৫০০/- তেই নিজেকে বিসর্জন দিতে মরিয়া। ফেসবুক খুললে বেসরকারি শিক্ষকদের আহাজারি চোখে পড়ে। তারা কি উচ্চাকাঙ্ক্ষী? না, মোটেও না। সরসার চালিয়ে নেওয়ার মতো বেতন হলে তারা খুশি। বেসরকারি শিক্ষকরা জাতীয়করণের জন্য কেন মরিয়া? দু'টি কারণে তারা জাতীয়করণ চায়। ১. মাসিক বেতনটি মোটামুটি সন্তোষজনক, ২. অবসর সুবিধা পেতে কোনো হয়রানি নেই। নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু এই কারিকুলাম যাকে দিয়ে বাস্তবায়ন করবেন তাকে নিয়ে কেন উচ্চবাচ্য হয় না? মাকে পুষ্টি না দিয়ে শিশুকে সুস্বাস্থ্যবান করার অবান্তর চেষ্টামাত্র। কোনো একজন বুদ্ধিজীবীকে টিভিতে বয়ান করতে দেখলাম ভালো শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের উচ্চ বেতন প্রয়োজন নেই। কম বেতনেও ভালো শিক্ষা দেওয়া যায়। আমার প্রশ্ন, তিনি তার সন্তানকে কোথায় পড়ান? স্বনামধন্য স্কুল-কলেজে সবাই বাচ্চা পড়াতে চায়। তারা কী জানেন না যে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের উচ্চ বেতন দেওয়া হয়। যাহোক, কলেবর বাড়াতে চাই না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে প্রথমে দরকার শিক্ষা ও শিক্ষকের উন্নয়ন। শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন ছাড়া একটি দেশ আগাতে পারে না।
আদালতের নির্দেশনার পর বেসরকারি শিক্ষকরা হালে পানি পাবেন। যেসব শিক্ষকের পাওনা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে সেগুলো দ্রম্নত পরিশোধ করা হোক।
যারা নতুন করে আবেদন করবেন অবসরের সুবিধার জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে দেওয়া হোক, যেদিন তিনি/তারা টাকা হাতে পাবেন। আবেদন সম্পূর্ণ হওয়ার পর তাদের মেসেজ দিয়ে টাকাপ্রাপ্তির ডেট জানানোর ব্যবস্থা করা হোক। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। আর যেটা না হলেই নয়, সেটা হল অবসর সুবিধা পেতে যে দুর্নীতি হয় সেটার কবর রচনা করা।
মাজহার মান্নান : কলাম লেখক