বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

বিডিআর হত্যাকান্ড ছিল সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র

বিডিআর হত্যাকান্ড দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সে ঘটনা শুধু বাংলাদেশের জনগণই নয়, বিশ্ব বিবেকও স্তম্ভিত করেছিল। একসঙ্গে এতসংখ্যক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের শিকার দেশের ইতিহাসে তো নয়ই, পৃথিবীতে নজির নেই। এটি আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতেই করা হয়েছিল। সরকার পতনই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের একমাত্র টার্গেট।
তাপস হালদার
  ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিডিআর হত্যাকান্ড ছিল সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র

২৫ ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর কালো অধ্যায়। ২০০৯ সালের এই দিনে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিল। কিছু বিপথগামী সৈনিকের বর্বরতার শিকার হয়ে তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা ও আরও ১৭ জন পরিবারের নারী ও শিশুসহ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।

২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র পঞ্চাশ দিনের মাথায় সংঘটিত হয় বিডিআর হত্যাকান্ড। বিদ্রোহের পর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে নানা মিথ্যা কল্পকাহিনী তৈরি করার চেষ্টা করে। যেমনটি করা হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হত্যাকান্ড নিয়ে। বিডিআর হত্যাকান্ড নিয়ে অপপ্রচার করা হয় আওয়ামী লীগের ইন্ধনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এর জন্য দায়ী। এর মাধ্যমে ভারত ২০০১ সালে রৌমারী সীমান্ত বিডিআর-বিএসএফ সংঘর্ষে ১৬ জন বিএসএফ সদস্য হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এসব প্রচারণা হাস্যকর ও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে। বেশ কিছু কারণে সেনাবাহিনীর ওপর তাদের ক্ষোভ ছিল। ২০০৭ সালে এক তরফা নির্বাচনকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বেগম খালেদা জিয়াসহ তার দুই পূত্রকে গ্রেপ্তার করে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল বলেই আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ও তাদের ভরাডুবি হয়। এসব কারণেই বিডিআরকে উসকে দিয়ে সেনা অভু্যত্থানের স্বপ্ন দেখেছিল বিএনপি।

তিন দিনব্যাপী বিডিআর সপ্তাহের প্রথম দিন ২৪ ফেব্রম্নয়ারি, প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রম্নয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ২৫ ফেব্রম্নয়ারি সকালে নারকীয় হত্যাকান্ডে ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়।

সেদিন অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বক্তব্য দিচ্ছিল এমন সময় কিছু বিদ্রোহী সৈনিক অতর্কিত হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যমতে, হামলা শুরু হওয়ার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হয়। তখন বিদ্রোহীরা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েন। তারা উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে বেলা দেড়টার দিকে সাদা পতাকা হাতে পিলখানার ৪ নম্বর গেট ঝিগাতলা যান তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মীর্জা আজম। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ১৪ সদস্যদের বিডিআর প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ও অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সন্ধ্যায় তারা ভোল পাল্টিয়ে সাধারণ ক্ষমার প্রজ্ঞাপন প্রকাশের দাবি করেন। আবারও বিশৃঙ্খলা শুরু করে এবং বিদু্যৎ সংযোগ বিছিন্ন করে সেনাকর্মকর্তাদের লাশ গণকবর দেয়। সরকার হার্ড লাইনে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলে অবস্থা বেগতিক দেখে ২৬ ফেব্রম্নয়ারি সকালেই বিদ্রোহীরা পোশাক পাল্টিয়ে অনেকেই যে যার মতো পালিয়ে যায়। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে রাতে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে পিলখানায় অবস্থানরত বিদ্রোহীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে অস্ত্র ও অস্ত্রাগারের চাবি বুঝিয়ে দেন এবং ৩৬ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটে। পুলিশ পিলখানার দায়িত্ব বুঝে নেয়। ২৭ তারিখ তলস্নাশি শুরু করলে একাধিক গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে মহাপরিচালক ও তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

২৮ ফেব্রম্নয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। ঘটনাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তিনটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করা হয়। বিডিআর, সেনাবাহিনী ও সরকার কর্তৃক এই তিন পর্যায়ে তদন্ত কাজ শেষ করা হয়। বিচার করার জন্য বকশিবাজার মাঠে অস্থায়ী আদালত বসানো হয়। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ঢাকা মহানগর তৃতীয় আদালতের বিচারক ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনের ফাঁসি, বিএনপির সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন পিন্টুসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন ও ২৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের পর চূড়ান্ত রায়ের জন্য মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে। তবে দ্রম্নত বিচারকার্র্য শেষ করে আসামিদের সাজা কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি।

বিডিআর হত্যাকান্ডে ইন্ধন জুগিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। ঘটনাপরবর্তী কার্যক্রমে দিবালোকে স্পষ্ট হয়েছে। হত্যাকান্ডের দিন ভোরে বেগম খালেদা জিয়া বাসা থেকে বের হয়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যাওয়া, লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের কথা মতো ভোরেই বাড়ি থেকে বের হওয়া এবং দুই দিন জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের দূতের ঢাকা সফর, সবই একই সূত্রে গাঁথা। দুদিন পর বেগম জিয়া অজ্ঞাত স্থান থেকে বের হয়ে সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে বললেন, সাধারণ ক্ষমা ভুল ছিল। এ বক্তব্যে প্রমাণ হয়, তিনি রক্তপাত চেয়েছিলেন। অথচ সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন তিনি জানতেন না ভেতরে কতজন মারা গেছেন। এজন্য তিনি আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করে দোষীদের আইনের আওতায় এনেছেন। সেজন্যই ৯০ জন সেনাকর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারের ৩০০ জন সদস্যকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। বল প্রয়োগ করা হলে ব্যাপক রক্তপাত ঘটতো। রাজধানীর বাইরের বিডিআর ও সেনাবাহিনী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত।

বিডিআর হত্যাকান্ডের আসামিদের পক্ষে আইনি লড়াই করেছেন বিএনপি জামায়াতের বড় বড় আইনজীবীরা। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম, সাবেক ছাত্র শিবির নেতা অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ, অ্যাডভোকেট সুলতানসহ একঝাঁক বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা।

বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী ডিএডি তৌহিদ, সিপাহি মাঈন, সুবেদার মেজর গোরফান মলিস্নকসহ অভিযুক্তরা বিএনপির সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। পালিয়ে যাওয়া বিডিআর সদস্য যাদের পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, তারা সবাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিএনপির সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সুপারিশে চাকরি পেয়েছিল। তদন্তে বের হয়, বিদ্রোহীরা ২৪ তারিখ বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর সঙ্গে বৈঠক করে এবং ঘটনার পর তাদের অনেককে পালাতেও সাহায্য করে। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শিত সেনা কর্মকর্তাদেরই হত্যা করা। এর মধ্যে ৩৩ জনই আওয়ামী পরিবারের সদস্য। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে বিএপির সংশ্লিষ্টতা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

বিডিআর বিদ্রোহে নিয়ে অনেকে 'ডাল ভাত কর্মসূচি'র ক্ষোভের কথা সামনে নিয়ে এসে আসল সত্যটা লুকানোর চেষ্টা করে। মাত্র পঞ্চাশ দিনের একটা সরকারের কাছে তাদের দাবি এতটা ক্ষোভের হতে পারেনা। এটি সুপরিকল্পিত একটি ষড়যন্ত্র। সৈনিকদের আবেগ ব্যবহার করে হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে।

বিডিআর হত্যাকান্ড দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সে ঘটনা শুধু বাংলাদেশের জনগণই নয়, বিশ্ব বিবেকও স্তম্ভিত করেছিল। একসঙ্গে এতসংখ্যক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের শিকার দেশের ইতিহাসে তো নয়ই, পৃথিবীতে নজির নেই। এটি আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতেই করা হয়েছিল। সরকার পতনই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের একমাত্র টার্গেট।

দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিআর পুনর্গঠনে ব্যাপক সংস্থার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বাহিনীর কলঙ্কিত ইতিহাস মুছে ফেলতে বিডিআরকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়েছে। আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি গর্বিত বাহিনী তৈরি হয়েছে। যারা অতন্দ্র প্রহরীর মতো বাংলাদেশের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে।

তাপস হালদার : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

যধষফবৎঃধঢ়ধং৮০@মসধরষ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে