বিশ্বমানের যে বিদ্যালয় তাকেই বলা যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। একটি বিদ্যালয় স্থানীয় মানে হতে পারে, অসুবিধা নেই। একটি কলেজ স্থানীয় মানে হতে পারে, তাতেও অসুবিধা নেই, কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থানীয় মানের ওপর নির্ভর করতে পারে না। বিশ্ব মানের স্ট্যান্ডার্ট বজায় থাকবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে- এটাই কাম্য। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও সুনাম দেশের গন্ডি পেরিয়ে যখন বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে, সারা বিশ্বের সুশীল সমাজ তার নামে-সুনামে আকৃষ্ট হয়; তখনই তিনি তার সন্তানকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি- আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান ও সুনাম নিম্নমুখী। তার আরও একটি প্রমাণ এখানে বর্ণিত হলো-
সপ্তাহখানেক আগে দেশের স্বনামধন্য একটি পত্রিকায় দেখলাম তারা ইউনিভার্সিটি গ্রান্ড কমিশন সংক্ষেপে ইউজিসি'র একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউজিসি গত তিন বছরের তথ্য সংগ্রহ করে একটি ডাটা প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশ থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবেই কমছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার চিত্রটি উঠে এসেছে গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি করা হয়েছে ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে। তখন দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫৩টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ১১০টি (১০০টির শিক্ষা কার্যক্রম ছিল)। অবশ্য এখন সংখ্যাটি আরও বেড়েছে। অধিভুক্ত কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ দেশের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ জন। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২০ সালে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ২ হাজার ৩১৭ জন। পরের বছর (২০২১) তা হয় ২ হাজার ২৮১ জন। ২০২২ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৫৭ জনে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কোনো বছরই এক হাজার ছাড়ায়নি। ১০ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই বছর ৮০৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ২০২২ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২৬টিতে ৬৭০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তেন। এর মধ্যে ছাত্র ৫০৪ জন ও ছাত্রী ১৬৬ জন। আগের বছর ২০২১ সালে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ৬৭৭ জন। ২০২০ সালে ছিলেন ৭৬৭ জন। মজার ব্যাপার হলো ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর রাজশাহী কিংবা চট্টগ্রাম নয়, বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা করছেন গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা গর্ব করে বলি প্রাচ্যের অক্সফোর্ট। তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ১৯১ জন। এর পরেই আছে দিনাজপুরে অবস্থিত হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ১১৭ জন। বিদেশি শিক্ষার্থীর দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২ জন। এ ছাড়া গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৯ জন, রাজধানীতে অবস্থিত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ জন। বাকি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী আছেন, সেগুলোর একেকটিতে ১৫ জনের নিচে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তে আসতেন। এ জন্য 'স্যার পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল' নামে আলাদা একটি আবাসিক হল করা হয়েছিল। বর্তমানে এই হলে যৎসামান্য বিদেশি শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তরুণ শিক্ষকরাও থাকেন। বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কোনো বছরই এক হাজার ছাড়ায়নি। ১০ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই বছর ৮০৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাক্রম চালু ছিল। তার মধ্যে ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন ১ হাজার ২৮৭ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ২৬০ জন ছাত্রী। আগের বছর ২০২১ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিলেন ১ হাজার ৬০৪ জন। এক বছরের ব্যবধানে ৩১৭ জন বিদেশি শিক্ষার্থী কমেছে। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ৩৭টি দেশের শিক্ষার্থীরা দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। দেশগুলো হলো- ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, দক্ষিণ সুদান, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ফিলিস্তিন, গাম্বিয়া, মরক্কো, কোরিয়া, নাইজেরিয়া, ইরান, তানজানিয়া, মিয়ানমার, রুয়ান্ডা, ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, সিয়েরা লিওন, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), জার্মানি, ক্যামেরুন, তুরস্ক, কেনিয়া, ঘানা, উগান্ডা, লাইবেরিয়া ও জিবুতি।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, একদিকে বিদেশি শিক্ষার্থী কমছে, অন্যদিকে, দেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন।
\হপ্রশ্ন হলো- বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কেন কমছে? এর বহু কারণ থাকতে পারে। সর্বাগ্রেই বলা যেতে পারে- মানসম্মত শিক্ষার অভাব। বিদেশি শিক্ষার্থীরা যে রকম শিক্ষা ব্যবস্থায় আকৃষ্ট হতো, সে রকম মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতভাবেই দেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষকের গোড়াতেই গলদ রয়েছে। যেমন স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতির মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক বাদ দিয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে ওই সব শিক্ষকদের পড়ানোর মান মানহীন। আন্তর্জাতিক মানদন্ডের অনেক নিচে। ওদের পড়ানোর দক্ষতা ও পারদর্শিতা বিদেশি শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে পারে না। এ কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী কমতে পারে। আবার বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য যে পরিবেশ দেওয়া দরকার, সেই পরিবেশ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই। আমাদের দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শ্রেণির ছাত্রদের তান্ডব চলে। হোক সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারি। এসব কর্মকান্ড বিদেশি শিক্ষার্থীদের মনে প্রভাব পড়ে বিধায় উচ্চশিক্ষার পরিবেশ বিদেশি শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে ওঠে না।
সর্বোপরি মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব। এমনিতেই ত্রম্নটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া কঠিন। তারওপরে কোনো দক্ষ শিক্ষক গড়ে ওঠার পর উচ্চশিক্ষার সুযোগে দক্ষ শিক্ষকরা বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসে না। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামগ্রিকভাবে সুগন্ধ ছড়াতে পারে না। এজন্যই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষর্থীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে।
পরিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্বনামধন্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনের একটি কথা দিয়েই আমার আজকের প্রবন্ধ শেষ করব। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাজ্যে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পাঁচ বছরে আমি যে পরিশ্রম করেছি, আমার মনে হয় এ পরিশ্রমের দরুন আমার আয়ু পাঁচ বছর কমে গেছে। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষকরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্নের নামে ছুটি নিয়ে পিকনিকের মতো মাস্তি করে দিন কাটায়। সে যাইহোক, বর্ণিত কারণগুলোতে কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে নজর দিলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়তো একটি সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করবে। আবার এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীতে পরিপূর্ণ হবে উঠবে।
মো. মাঈন উদ্দিন :কলাম লেখক