ভারতের ৮১ লাখ নাগরিক এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে জেগে পোস্ট অফিসের একটি চিঠি পেল। জানলো তারা আর ভারতের নাগরিক নন। তাদের আধার কার্ড ডিঅ্যাকটিভ হয়ে গেছে, পাশাপাশি, বয়স্ক একাউন্টও ডিঅ্যাক্টিভ হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেল তাদের রেশন, গ্যাস সিলিন্ডার ক্রয়, বন্ধ হয়ে গেল ব্যাংকের সব লেনদেন, বন্ধ হয়ে গেল তাদের শিশুদের লেখাপড়ার অধিকার। এক, ১৪ বছরের কন্যা কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করছে, তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া হবে না। পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা বনকাটি পঞ্চায়েতের ১১ মাইলের বীরভূমের ইলামবাজারে কবি জয়দেব মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী, যার মাস পরেই পরীক্ষা। কয়েকদিন আগে সে ফর্ম ফিলআপ করতে যায় এবং জানতে পারে তার আধার কার্ড বাতিল হয়ে গেছে।
আধার কার্ড বাতিলের নোটিসকে ঘিরে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে ভারতে। সঠিক তথ্য না থাকার কারণেই আধার কার্ড বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
\হতিনি জানিয়েছেন, আধার কার্ড বাতিল বা নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা রয়েছে ইউআইডিএআই-এর হাতে। আধার কার্ড রেগুলেশনের ২৭ এবং ২৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কোনোভাবে একই ব্যক্তির নামে দু'টি পৃথক আধার কার্ড জারি করা হলে বা তাতে কোনো গন্ডগোল থাকলে, কার্ড বাতিল বা নিষ্ক্রিয় করা হয়ে থাকে। রাজ্যসভায় আধার কার্ড বাতিলের কথা গত শুক্রবারই ঘোষণা করেছিলেন কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পি পি চৌধুরী।
ভারতজুড়ে ৮১ লাখ আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে কেন্দ্র। পূর্ব বর্ধমানের অন্তত ৬০ জনের আধার কার্ড বাতিল করা হয়েছে- তারা পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর বস্নকের জুহিহাটি, জৌগ্রাম, আবুজোহাটি এলাকার বাসিন্দারা। রাঁচিতে ভারতের ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথোরিটির আঞ্চলিক অফিস থেকে চিঠিগুলো জারি করা হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছেছে আধার কার্ড বাতিলের চিঠি। জামালপুর, দুর্গাপুর, কৃষ্ণগঞ্জ, নাকাশিপাড়ায় বাড়ি বাড়ি আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি এসেছে। সবচেয়ে বেশি মতুয়াদের, তাদের কার্ডগুলো ডিনোটিফাই করা হচ্ছে। নমঃশূদ্রদের করা হচ্ছে এবং যারা গরিব, ক্ষেতমজদুর, খেটে খাওয়া মানুষ। বর্ধমান, নদিয়ার পর বাতিল হয়েছে মগরার বাসিন্দাদের আধার! মগরা-১ পঞ্চায়েত এলাকার প্রায় ৫০ জন বাসিন্দার কাছে স্পিড পোস্ট মারফত এসে পৌঁছয় ওই চিঠি। এরপর বর্ধমান, নদিয়ার পর হুগলি। বৃহস্পতিবার, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় বলেছেন, 'উত্তরবঙ্গে চা বাগানের শ্রমিকদের আধার কার্ড বাতিল করা হয়েছে। আমি প্রশাসনকে ঘটনাটি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আমি শুনেছি যে, আধার কার্ড বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- যাতে লোকজন আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ভোট দিতে না পারে।' আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় চিঠিগুলেতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, 'চিঠির প্রাপক ২০১৬ সালে পাস হওয়া আইনের শর্ত পূরণ করেননি।' সেই আইনের ২৮(এ) ধারা অনুসারে ভারতীয় ভূখন্ডে বসবাসের জন্য যোগ্য বা প্রয়োজনীয় নথি দেওয়ার কথা উলেস্নখ করা হয়েছে। পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গেছে, পোস্ট অফিসে থেকে চিঠি এসেছে, যার মধ্যে অনেক শনিবার বিলি করা হয়নি। ফলে, আজ সোমবার আরও অনেক বাসিন্দার বাড়িতে আধার বাতিল হওয়ার চিঠি যাবে। যাদের আধার বাতিল করা হচ্ছে তাদের রেশনসহ অন্যান্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এবার পঞ্চায়েতের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়েছেন পঞ্চায়েত কর্তারা। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, তারা রেশন পেতে সমস্যায় পড়েছেন আবার কেউ কেউ ব্যাংক লোন পাচ্ছেন না। লোকসভা ভোটের আগে এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও তৈরি হয়েছে। আধার কার্ড বাতিল নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগর ঠাকুর বাড়িতে বৈঠক করলে অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মতুয়া মহাসংঘের সংঘাধিপতি মমতা ঠাকুর সহ-সংঘের সদস্যরা এবং মতুয়া ভক্তরা। মমতা ঠাকুর বলেন, 'যাদের আধার কার্ড বাতিল করা হচ্ছে তার মধ্যে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই মতুয়া সম্প্রদায়ের। জেলায় জেলায় আধার কার্ড বাতিলের অভিযোগে এবার আন্দোলনের হুঁশিয়ারি সারা ভারত মতুয়া মহাসংঘের। অবিলম্বে সমস্যার সমাধান না হলে আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি দিলেন মতুয়া মহাসংঘের সংঘাধিপতি মমতাবালা ঠাকুর। আধার কার্ড বাতিল প্রসঙ্গে এদিন শান্তনু ঠাকুর বলেন, 'যে সমস্ত মানুষের যারা ওপার বাংলা (বাংলাদেশ) থেকে এসেছেন, যাদের আধার কার্ড ডিঅ্যাকটিভ হয়ে গেছে, পাশাপাশি, বয়স্ক অ্যাকাউন্টও ডিঅ্যাক্টিভ হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তার রাজ্যের লোকেদের আধার কার্ডের 'হঠাৎ নিষ্ক্রিয়করণ' নিয়ে চিঠি লিখেছেন, 'বিশেষ করে যারা' ঝঈ, ঝঞ এবং ঙইঈ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। তিনি আরও জোর দিয়েছিলেন যে, এই ধরনের একটি 'নিষ্ক্রিয়করণ' ন্যায়বিচারের চরম লঙ্ঘন। ব্যানার্জি সোমবার সচিবালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, আধার কার্ডগুলোর 'নিষ্ক্রিয়করণে'র পেছনে 'উদ্দেশ্য' ছিল নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন তৈরি করা। তিনি আরো বলেছেন যে, তার সরকার 'নিষ্ক্রিয়' কার্ডগুলোর পরিবর্তে বিকল্প শনাক্তকরণ কার্ড সরবরাহ করবে এবং মঙ্গলবার থেকে একটি আধার অভিযোগ পোর্টাল কাজ শুরু করবে। 'আমি লোকেদের বলব যে, তাদের আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে কিনা তা পোর্টালে জানাতে। তাদের একটি বিকল্প পরিচয়পত্র দেয়া হবে, যাতে বাংলার মানুষ তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। আধার কার্ড না থাকলে চিন্তা করবেন না। আমরা আরেকটি কার্ড ইসু্য করব। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে আমরা একটি পৃথক কার্ড ইসু্য করব যাতে কেউ আমাদের কোনো সামাজিক কল্যাণ প্রকল্প থেকে বঞ্চিত না হয়'। 'নির্বাচনের ঠিক আগে কার্ড নিষ্ক্রিয় করা... এটা কি ধরনের রাজনীতি?' প্রশ্ন করেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান। অন্যদিকে, পাঞ্জাবে চলছে কৃষকদের আহজারি। ভারতীয় কৃষকরা নিশ্চিত ফসলের দামের দাবিতে ধর্মঘট করছে। কৃষকরা হাইওয়ে অবরোধ এবং শুক্রবার উত্তর ভারতের অনেক গ্রামীণ এলাকায় বিক্ষোভ এবং ট্রাক্টর ও ওয়াগনে রাজধানীর দিকে যাত্রা করেছে। উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের কৃষকরা প্রধান মহাসড়কের টোল পস্নাজার কাছে অবস্থান নিয়েছিল। কয়েক হাজার কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্যের নিশ্চিত মূল্যের দাবিতে এই সপ্তাহের শুরুতে নয়াদিলিস্নর দিকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেছিল, কিন্তু রাজধানী থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে পুলিশ তাদের থামিয়ে দিয়েছিল। কংক্রিট ও ধাতব ব্যারিকেড দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে কৃষকরা পাঞ্জাব ও হরিয়ানার সীমান্তে ক্যাম্প করছে। পুলিশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক, কর্তৃপক্ষ হরিয়ানার কিছু এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত, কিছু প্রতিবাদী নেতাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো বস্নক এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাসের ক্যানিস্টার ফেলতে ড্রোন ব্যবহার করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা একই ধরনের বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছেন কয়েকবার। কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা, বৃহস্পতিবার খামার নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তবে বিক্ষোভকারী ভারতীয় কৃষকরা সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে যে, তারা রাজধানী নয়াদিলিস্নতে তাদের পদযাত্রা চালিয়ে যাবে। সোমবার রাতে, আন্দোলনের নেতারা বলেছিলেন যে, তারা ডাল, ভুট্টা এবং তুলা ফসলের জন্য নিশ্চিত মূল্যের জন্য পাঁচ বছরের চুক্তির সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। রোববার দেওয়া সরকারের প্রস্তাবটি 'কৃষকদের স্বার্থে নয়,' প্রতিবাদের নেতৃত্বদানকারী অন্যতম নেতা জগজিৎ সিং ডালেওয়াল প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সিকে বলেছেন। আধার কার্ড ডিঅ্যাকটিভ বা নিষ্ক্রিয় বা বাতিল এবং কৃষক বিক্ষোভগুলো ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঘটছে। কারণ আগামী মাসগুলোতে জাতীয় নির্বাচন হবে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মোদির জন্য কৃষকরা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর হরিয়ানাসহ আরও কয়েকটি রাজ্য ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দ্বারা শাসিত। আর বাংলায় বিজেপি সব সময় দুর্বল। তারা যে কোনো মূল্যে বাংলা দখল করতে চায়। তাই বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নেয়া বর্তমান ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি তাদের লক্ষ্য বা ভবিষ্যৎ এ তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের আগে এটি একটি কৌশল নির্ধারণও হতে পারে। বিজেপি বহু আগে থেকেই বাংলাদেশ থেকে আশ্রয় নেয়া মানুষের বিরুদ্ধে। তাই তারা একটি আইনি পরিপূর্ণ তালিকা চায় বা তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। যাতে নির্বাচনের পরে যে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়। বিজেপি সব সময় মুসলিম বিরোধী। একে একে প্রাচীন মসজিদকে মন্দিরের নামে দখল, তাদের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের কৌশল। এবার তারা পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশ থেকে বিগত পঞ্চাশ বৎসর ধরে আশ্রয় নেয়া মানুষের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণকে উসকানি দিচ্ছে। যার মূল কারণ পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় আসা। যা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে। কানাডায় ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকান্ডের ইসু্যতে মোদি সরকার আর কানাডার মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, আরব ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভারত বর্জন আন্দোলন শুরু হয়েছে। সুতরাং, মোদির বিজেপির বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ বিশ্বে ভারতের সুনামকে ক্ষুণ্ন করছে।
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি : কলাম লেখক