নিজের দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধই হলো দেশপ্রেমের উৎস। মানুষ বুদ্ধিমান জীব। তাই সে বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনা নির্দেশে পরিচালিত হয়। জীব হিসেবে মানুষের মধ্যে পশুত্বও থাকে- পাশবিক শক্তিও তাকে প্রভাবিত করে। তবে মানুষের মধ্যে পশুশক্তির পাশাপাশি তার মধ্যে বিবেচনা দেশপ্রেম ও শক্তি উভয়ই বিদ্যমান। তাই মানুষ বিবেকের পরিচালনায় পরিচালিত হয়ে তার মনের পশুশক্তিকে শৃঙ্খলিত করে রেখে মনুষ্যত্ব গুণকেই অন্তরে সদাজাগ্রত করে রাখে। সৃষ্টিকর্তা পশুর মধ্যে জ্ঞান দান করেননি, কিন্তু মানুষের মধ্যে জ্ঞান দান করেছেন। এর ফলে, মানুষ জ্ঞানের আলোকে ইতরপ্রাণী অপেক্ষা জীব হিসেবে বহুগুণ শ্রেষ্ঠ। যেসব মানুষ নিজের কথা না ভেবে অর্থাৎ আত্মচিন্তায় নিমগ্ন না থেকে পরের মঙ্গলের জন্য বা দেশ ও দশের হিতার্থে আত্মোৎসর্গ করে তাকে মহৎ মানুষ বলা হয়। মহৎ মানুষের চিন্তা ও কর্ম সব সময় সমাজকেন্দ্রিক ও দেশকেন্দ্রিক। তারা সব সময় দেশ, জাতি ও সমাজকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। কীভাবে দেশের মঙ্গল হবে, কীভাবে দেশের মানুষের কল্যাণ সাধিত হবে সে সম্পর্কে তারা সব সময় নিজেদের ব্যাপৃত রাখেন। তারা কখনো নিজেদের কথা ভাবেন না। সমাজের মানুষের মধ্যে সব ধরনের মানবীয় গুণাবলি জাগিয়ে তোলার স্পৃহা দেখা দেয়। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের করণীয় অনেক- আর করণীয় কর্ম করতে গেলে মানুষকে হতে হবে উদার ও মানবপ্রেমিক, মানবিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন অপরিহার্য। দেশের মানুষকে ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধই হলো দেশপ্রেমের উৎস। স্বদেশপ্রেম থেকে বিশ্বপ্রেম, যে নিজের দেশকে ভালোবাসে, সে বিশ্বপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক মানবতাবাদী। যে কোনো ব্যক্তি স্বদেশের মাটি, পানি, আকাশ-বাতাস, পরিবেশ, মানুষ ও কৃষ্টি- এই সবকিছুর মধ্যে শিশুকাল থেকেই যে মায়ের আদলে পরিপুষ্ট হতে থাকে। স্বদেশের সঙ্গেই গড়ে ওঠে তার নাড়ির সম্পর্ক। তার দেহ ও মনে বিশ্বাস, আদর্শ সবকিছুই স্বদেশের বিভিন্ন উপাদান দ্বারা পুষ্ট; ফলে স্বদেশের জন্য তার যে প্রেম তা কৃতজ্ঞতা, কর্তব্যের এবং দায়িত্ববোধ চর্চায় নিজেকে আত্মনিয়োজিত করে রাখা হয়। বস্তুত মা, মাটি ও মানুষকে ভালেবাসার মধ্যেই দেশপ্রেমের মূল সত্য নিহিত। ফলে সে দেশের ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য সমাজ সংস্কৃতি এবং জীবন ও পরিবেশের সঙ্গে যেমন গড়ে উঠে তার শেকড় বন্ধন, তেমনি মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি সৃষ্টি হয় চিরায়ত গভীর ভালোবাসার আবেগময় প্রকাশই হচ্ছে দেশপ্রেম। চিন্তায়, কথায় ও কাজে দেশের জন্য যে ভালোবাসা প্রকাশ পায় সেটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে হয় স্বদেশপ্রেম যেসব বৈশিষ্ট্য দ্বারা উজ্জ্বল সেগুলো হলো- আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সরলতা, শর্তহীনতা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব, কর্তব্য এবং একাত্মবোধ স্বদেশের কাছে মানুষ সব দিক দিয়েই ঋণী, স্বদেশপ্রীতি, সে ঋণ স্বীকার ও ঋণ শোধের উপায় মাত্র। গর্ভধারিণী জননীকে সন্তান যেমন ভালোবাসে তেমনি দেশ মাতৃকাকেও মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই শ্রদ্ধা করতে এবং ভালোবাসতে শেখে। দেশ ও দশের প্রতি মানুষের যে বন্ধন ও আকর্ষণ তা থেকেই স্বদেশপ্রেমের জন্ম। দেশ যত ক্ষুদ্র বা যত দরিদ্রই হোক না কেন। প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে তার জন্মভূমি, তার দেশ, সবার সেরা, সব দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। যে কোনো ব্যক্তির সব প্রাপ্তি তার স্বদেশের অবদান বলে স্বদেশের প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সে তার ধন-দৌলত, জশখ্যাতি-মান, এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসগ করতে দ্বিধা করে না। দেশ ও জাতীয় জীবনে যখন সুখ আর ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য থাকলেই স্বদেশপ্রেম থাকবে এমন নয়। দুঃখ, নির্যাতনের আঘাতে আঘাতেই হয় সেই সুপ্তি-মগ্নতার আবরণ উন্মোচন। দেশের যখন সংকটমুহূর্ত, যখন বহিঃশত্রম্ন উলস্নাস-অভিযানে দেশের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয়। তখন রক্তচক্ষু বিদেশি শাসকের নির্যাতন চরমে, যখন পরাধীনতার বিষে জর্জরিত মানুষ মুক্তি কামনায় উদ্বেল-অস্থির, যখন দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়- তখনই আসে মানুষের স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষলগ্ন। তখন দেশাত্মবোধ শ্রেণি -বর্ণ-গোত্র সব ভুলে একই ভাবচেতনা দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে। স্বদেশপ্রেম তখন মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। সবাইকে একই চেতনায় একপ্রাণ হয়ে মহৎ লক্ষ্য সাধনে ব্রতী করে। গড়ে ওঠে মানবসম্প্রীতি প্রাণপ্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয়তাবোধ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান উৎস। কত বীরের আত্মবলিদানে তখন স্বদেশের মৃত্তিকা হয় রক্তে রাঙা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তো স্বদেশপ্রীতিরই জ্বলন্ত স্বাক্ষর। দেশের দুর্দিনে বা অমঙ্গলে শঙ্কিতচিত্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং নিঃশর্ত আত্মত্যাগী হয়ে ওঠেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নির্দ্বিধায় জীবনকে উৎসর্গ করেন। যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে জীবন উৎসর্গ করার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়েছেন তিতুঁমীর, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন এরাই অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপস্নবী নায়ক। তাদেরও সাহস ও আত্মত্যাগের তুলনা হয় না। ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের মর্মান্তিক মৃতু্য, তার দেশপ্রেম ও সাহসিকতা এ উপমহাদেশের মানুষকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। মাতৃভাষায় মর্যাদা রক্ষার জন্য শহীদ হয়েছেন, রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্ম্নবিসর্জিত অসৎখ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, লাখ লাখ মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অকুতোভয় সৈনিকদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারি।
এছাড়া উপমহাদেশের শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নিজেদের সুখশান্তি বিসর্জন দিয়ে দেশপ্রেমের অম্স্নান স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেশপ্রেমের উৎকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বাহান্নর ভাষা শহীদরা দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে রেখে গেছেন যা সত্যিই বিরল। দেশে দেশে যুগে যুগে দেশপ্রেমিক সংগ্রামী মানুষরা এভাবেই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। কেউ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, কেউ হয়েছেন গুলিবিদ্ধ কেউ জীবন কাটিয়েছেন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। তাদের এই আত্মত্যাগ ও জীবনদানের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। অর্জিত হয়েছে বিজয়। নিজেরা জীবন দিয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পবিত্র ইসলাম ধর্মে ঘোষিত হয়েছে দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই, যে দেশকে ভালোবাসায় নির্দেশ দেয়া হয়নি। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমের একটি অংশ। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। বরং স্বদেশপ্রীতির ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রীতির এক মহৎ উপলব্ধি ও জাগরণ। পৃথিবীতে বীর, বিপস্নবী, ত্যাগী মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা কম নয়। দেশে দেশে এই মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষ তাদের ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন। কবি বলেছেন-
'স্বদেশের উপকারে নেই যার মন
কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন।'
কবির ভাষায়-
স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়
দাসত্বশৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়, হে
কে পরিবে পায়।
দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ ও অমূল্য সম্পদ। একটি মহৎ গুণ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দেশপ্রেম থাকা উচিত।
\হদেশপ্রেমের মূল লক্ষ্য মানুষকে ভালেবাসা। দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই অংশ বিশেষ। ব্যক্তিস্বার্থকে ত্যাগ করে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে ভালোবাসাই দেশপ্রেম। আর দেশের ঊর্ধ্বে সমগ্র পৃথিবীকে ভালোবাসাই বিশ্বপ্রেম। বিশ্বপ্রেমের মধ্য দিয়ে সবার সঙ্গে উদার ভ্রাতৃত্ব ঘোষণা করে বলতে হবে- সুতরাং, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কিছু না কিছু অবদান রাখা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মোশারফ হোসেন : প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান ও
কলাম লেখক; সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা